অবিচুয়ারি: আসাদ চৌধুরী

Share

আমি কবিতা-লেখার আগে থিকাই কবি হিসাবে আসাদ চৌধুরী’রে চিনতাম। উনার কবিতার কারণে না ঠিক, আমাদের এলাকায় একটা প্রোগ্রামে আসছিলেন। স্কুলে পড়ি আমি তখন। অই প্রোগ্রামে এম.সি. (মাস্টার অফ সিরমনি) মানে তখনকার দিনে কইতো – ‘উপস্থাপক’, ছিলাম আমি।

তো, স্টেইজে অতিথিদের সিরিয়াস-মুখ নিয়া বইসা থাকতে হইতো তিন-চাইর ঘন্টা। (মোবাইল টিপাটিপি করারও কোন উপায় ছিল না! মানে, মোবাইল ফোন তো তখন ছিল না।) অন্য বক্তাদের কথা শুনতে হইতো, এবং তেমন কোন এক্সপ্রেশন শো করা যাইতো না। এতোক্ষণ বইসা থাকতে থাকতে উনি মেবি টায়ার্ড হয়া গেছিলেন, এই কারণে একটু পরে উইঠা, পর্দার আড়ালে গিয়া সিগ্রেট ধরাইলেন, কাধের ঝোলা-ব্যাগ থিকা পান বাইর কইরা খাইলেন। (তখনকার দিনে কবি হইতে হইলে ঝোলা-ব্যাগ রাখতে হইতো।) আমি ব্যাক-স্টেইজের চেয়ারে বইসা উনার কাজ-কাম দেখতেছিলাম।

কবি জিনিসটা কি রকম – সেইটা বুঝার ট্রাই করতেছিলাম মনেহয়। স্টেইজে ফিরার সময় যখন আমারে ক্রস করে যাইতেছিলেন, তখন সালাম দিলাম, উনি হাসলেন একটু।

উনি বক্তৃতা দেয়ার সময় খুব রসায়া রসায়া কথা বলতেছিলেন। অডিয়েন্স খুব খুশি হইছিল।

পরে খেয়াল কইরা দেখলাম মোটামুটি ৩০ বছর পরে আমার মেয়ের স্কুলেও উনি একটা প্রোগ্রামে আসছিলেন। মানে, উনি স্কুল-কলেজের নানান প্রোগ্রামে যাইতেন। টিভিতেও ‘অনুষ্ঠান’ করতেন। উনার কথার ভঙ্গি ছিল সুরেলা। টাইনা টাইনা কথা বলতেন। মনে হইতো, পুঁথি পড়তেছেন। উনার কথা শুনতে ভাল-লাগতো। ভাল্লাগতো উনার টোনের কারণেই মনেহয়।

উনার কবিতা তো পড়ছি পরে, কিন্তু কবিতার কথা তেমন মনে নাই। “তবক দেয়া পান” নাম’টাই খালি বলা হয় উনার কবিতার ব্যাপারে। (উনার পয়লা কবিতার বইয়ের নাম এইটা।) কিছু ‘ভালো কবিতা’-ও উনি লেখছেন মেবি, অই সময়ের। কিন্তু কবি-হওয়াটা যে একটা পারফরমেন্সেরও ঘটনা – এই জিনিসটারে উনি কিছুটা ফিরায়া নিয়া আসতে পারছিলেন। মানে, একটা সময়ে কবিতা তো পারফর্ম করা লাগতো, গানের মতো না হইলেও আসরে, মজমায়, আড্ডাতে পড়া লাগতো। একটা ইন্ট্রো, কিছু ঘটনা, কনটেক্সট, রিলিভেন্সসহ। আসাদ চৌধুরী অই জায়গাটাতে ইউনিক ছিলেন।

সাহিত্য-সমাজ এবং কবি-সমাজের লোক তো ছিলেনই, কিন্তু অই গ্রুপগুলা কুটনামিগুলা করার ভিতরেই নিজেদেরকে পুরাপুরি লিমিট করে নাই তখনো; বরং অইখানে পারফরমেন্সের কিছু ঘটনাও ছিল (এখনো কিছু স্পেইস তো আছেই, সবসময় থাকেই কিছু…), অইখানে আসাদ চৌধুরী আমার ধারণা অনেকেরই কিছুটা ‘ঈর্ষার পাত্র’ হইতে পারতেন, কিন্তু মেবি ‘টিটকারি’-ই পাইছিলেন। নিজের কবিতা পড়ার জন্য যারে অন্য গলা ধার করতে হয় নাই! মানে, আবৃত্তিকার খুঁজতে হয় নাই। কিন্তু কবি যদি নিজেই কবিতা পড়েন, আবৃত্তিকাররা কি করবে তাইলে! যে কবিতা পড়ে সে তো ‘আবৃত্তিকার’, কবি তো ততোটা না! এই রিস্ক বা জাজমেন্ট (মানে, টিটকারি তার পাওনা) ছিল।

তো, ‘আধুনিক বাংলা-কবিতা’ অই জায়গাটা হারায়া ফেললেও, সমাজে অই ভ্যাকুয়ামটা এখনো আছে; আমরা এক্সপেক্ট করি যে, একজন কবি সুন্দর কইরা কথা বলতে পারবেন, ভালো ফ্লার্ট করতে পারবেন, খালি কবিতাই লেখবেন না, কবিতা নিয়া কথাও বলতে পারবেন; মানে, রিডারের লগে, অডিয়েন্সের লগে বাত-চিত করবেন। আসাদ চৌধুরী এই কাজটা করতে পারতেন। যদিও স্যাডলি এক ধরণের ‘আধুনিক কবিতা’-ই উনি লেখছেন বা লেখতে চাইছেন। (‘হয় নাই’ যদিও।) “ওপারে ভালো থাকবেন”রেই উনি আপনাইছেন। যারা উনার কথা শুনছেন এবং উনার কবিতা পড়ছেন – এই জিনিসটা টের পাওয়ার কথা যে, এর মধ্যে ব্রিজিংটা উনি তেমন তৈরি করতে পারেন নাই।

কিন্তু একজন কবি কি পারছেন তার চাইতে অনেক সময় কি পারেন নাই – সেইটাও অনেক ইম্পর্টেন্ট ঘটনা হয়া উঠে। মানে, আসাদ চৌধুরী তো একটা কবি-সমাজের ঘটনাই ছিলেন। সমাজে ‘কবি’ পরিচয় নিয়া বাঁইচা ছিলেন। আজকে মারা গেলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!

ইমরুল হাসান

কবি, ক্রিটিক, ফিকশন-রাইটার, ট্রান্সলেটর। জন্ম ১৯৭৫ সালে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

  • October 6, 2023