
বিজ্ঞান যে সংস্কৃতি দিয়ে প্রভাবিত তা স্ব-বিজ্ঞাপিত (সেলফ-এডভার্টাইজড) বিজ্ঞানমনস্করা সহজে মানতে চান না। বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য (পারপাস), আর ফলাফল (প্রোডাক্ট) সংস্কৃতির মধ্যেই নিহিত (এমবেডেড ইন কালচার), সংস্কৃতির সাথে নিবেশিত (এনগেজড উইথ কালচার), এবং সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত (ইনফ্লুয়েন্সড বাই কালচার)।
এই যে বিজ্ঞানের পারপাস সংস্কৃতির কারনে আলাদা হইতে পারে, এটার একটা সহজ উদাহরণ হইলো বাংলাদেশের স্পারসো আর ইন্ডিয়ার ইস্রো – দুইটাই মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। কিন্তু স্পারসোর উদ্দেশ্যগুলার মধ্যে প্রথম হইলো কৃষি উন্নতি, আর ইস্রোর জন্য তা মহাকাশযান ক্ষেপণ। বিজ্ঞানের প্রোডাক্ট বা বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞান (সাইন্টিফিক নলেজ) যে আলাদা হয় সংস্কৃতিভেদে, তার উদাহরণ হইল, – ইস্টার্ন মেডিসিন – ওয়েস্টার্ন মেডিসিন। এছাড়া সংস্কৃতিভেদে বিজ্ঞানের ভিন্ন গুরুত্ব (এম্ফাসিস) তো আছেই, যেমন মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্ব (কসমোলোজি), পরিবেশ সংরক্ষণ (এনভায়রনমেন্টাল সাস্টেইনেবিলিটি), মানসিক স্বাস্থ্য, নিউক্লিয়ার ওয়াপোন ইত্যাদি।
এপ্রসঙ্গে ওয়োং আর হডসনের একটা লেখা ভালো লেগেছে – বিজ্ঞানের জ্ঞান যেহেতু সাংস্কৃতিক অবকাঠামোর ভেতরেই নির্মিত, তাই তা বিজ্ঞানীদের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা (কালচারাল এক্সপেরিয়েন্স), বিশ্বাস (বিলিফ), আগ্রহ (ইন্টারেস্ট), মূল্যবোধ (ভ্যাল্যু), আর গুরুত্ব (এমফাসিস), আর মনোভাব (এটিচিউড) প্রতিফলন করে (করবেই)।
বিজ্ঞানের পারপাস আর প্রোডাক্ট যদি এত তরলই হবে (ফ্লুইড), তাইলে বিজ্ঞানের বিশেষত্ব কি? বিশেষত্ব বিজ্ঞানের প্রক্রিয়া (প্রসেস)। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কিছু নির্দিষ্ট ধাপ অনুসরণ করে, এই ধাপগুলাই মূলত বিজ্ঞানের ফলাফলকে নিরপেক্ষ (আনবায়াসড) বানায়, বা বানানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। কিন্তু আবারও মনে রাখা দরকার, একজন বিজ্ঞানী সংস্কৃতি বা আবেগের ঊর্ধে না। তাই প্রথমত বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞান নিরপেক্ষ হইলেও তার আখ্যান (ন্যারেটিভ) পক্ষপাত হইতেই পারে (হয়েই থাকে)। আর জনমানুষ জ্ঞানের চেয়ে নিশ্চই আখ্যান বেশি গ্রহন করে। আর দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানের পদ্ধতির একটা অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য হইলো, কোন ফলাফলকেই পরম সত্য না মেনে নেয়া। তারমানে বিজ্ঞানের জ্ঞানকে প্রতিনিয়ত প্রশ্ন করতে হবে, আর তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। তাই বিজ্ঞানের ফলাফল আপেক্ষিক না হইলেও অন্তত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সাপেক্ষিক।
তো বিজ্ঞানের এই স্বভাব (নেচার অফ সায়েন্স), যা সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা স্ব-বিজ্ঞাপিত (সেলফ-এডভার্টাইজড) বিজ্ঞানমনস্করা সহজে মানতে চান না কেন? এর অনেকগুলা উত্তরের মধ্যে একটা উত্তর হইতে পারে যে, মানবীয় সকল কর্মকাণ্ডের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে; আর বিজ্ঞান এর ঊর্ধে না। আর ক্ষমতা ততক্ষণই কার্যকর যতক্ষণ তা অগম্য (আনরিচেবল), আর অনধিগম্য (ইনেক্সেসিবল), আর অবোধগম্য (ইনকম্প্রেহেন্সিবল)। তাই বিজ্ঞানকে আবেগবিবর্জিত (আনইমোশোনাল), সংস্কৃতি থেকে ঊর্ধে বিক্রি করলে স্বর্ণের তোলার মত দাম আসে। হইতে পারে এই জন্যই স্ব-বিজ্ঞাপিত বিজ্ঞানমনস্করা বিজ্ঞানের তরলতাকে অস্বীকার করে থাকেন।
বিজ্ঞানের জন্য সংস্কৃতি নাকি সংস্কৃতির জন্য বিজ্ঞান? নাকি মানবজাতির কল্যানের জন্য সংস্কৃতি আর বিজ্ঞান? আমাদের বিজ্ঞান বিক্রয়কারীরা স্বাধারণত (আমার অভিজ্ঞতা এবং উপাত্ত সাপেক্ষে) বিজ্ঞান আর সংস্কৃতিকে মেরুকরণ (পোলারাইজ) করে থাকেন। বিজ্ঞানকে সংস্কৃতির ঊর্ধে বিক্রি করলে বিজ্ঞানের আভিজাত্য টিকে থাকে ঠিকই, কিন্তু সমাজের একটা বড় অংশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা (ক্রেডিবিলিটি) চলে যায়। অপরপক্ষে বিজ্ঞানবিবর্জিত সংস্কৃতি বাস্তবিকভাবে অসম্ভব (রিয়েলিস্টিকালি ইম্পসিবল)।
এখন বিজ্ঞানের আসল উদ্দেশ্য যদি মানবকল্যাণই হয়ে থাকে, সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে তা করা সম্ভব না। আর একই যুক্তি সংস্কৃতির বেলায়ও প্রযোজ্য। অর্থাৎ সংস্কৃতিকে যেমন বিজ্ঞানের সাথে তাল মিলায় আগাইতে হবে, বিজ্ঞানকেও তেমন সংস্কৃতির প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল হয়েই আগাইতে হবে। বিজ্ঞান আর সংস্কৃতি কোনওটাই আরোপিতভাবে মানুষের কল্যাণ করতে পারবে তা আমি মনে করি না। আর বিজ্ঞান আর সংস্কৃতি দুই মেরুতে থেকেও কিছু করতে পারবে না। মানবকল্যাণই যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। নমনীয়তা (ফ্লেক্সিবিলিটি) থাকতে হবে, সহনীয়তা (টলারেন্স) থাকতে হবে। তা না হইলে আত্মবাদী বিজ্ঞান (ইগোটিস্ট সায়েন্স) আর স্বত্বচেতা সংস্কৃতি (সেলফ-কনশাস কালচার) দুইটার একটাও সংখ্যাগরিষ্ঠদের তেমন উপকারে আসবে না।
Leave a Reply