
দুই.
[বাংলা-ভাষায় ঈদ নিয়া লেখা সেকেন্ড-বেস্ট কবিতা হইতেছে আহসান হাবীবের এই কবিতা’টা। অথচ এই কবিতাটার কথা তেমন শোনা যায় না। ১৯৪৭ সালে লেখা, ঢাকা শহরের শুরুর দিকের কবিতা এইটা।]
…
কোনো বাদশা’যাদীর প্রতি
আহসান হাবীব
নীল আকাশ,
রঙিন ঊষা
আর সবুজ তৃণে গড়ের মাঠ।
-আজ আমাদের ঈদ!
বাদশা’যাদী,
তুমি আসবে তো?
কার্জন পার্কের মোড়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো;
মাঠ থেকে ফিরে এসে
তোমায় লিফট করবো।
উহু গাড়ি কোথায়!
লিফট ক’রব-মানে
ওটা একটা কথার কথা।
আমরা হেঁটেই যাবো।
আমার পরনে থাকবে পা’জামা
গায়ে একটা সবুজ ডোরাকাটা শার্ট।
মাথার টুপিটা কালো,
তাতে পাঁচ সাতটা হলুদ বরণ ফুল।
পায়ে বাটা কোম্পানীর ক্যানভাস্।
লাল রঙের সিল্কের রুমাল
টাই করে গলায় বাঁধা।
আর তুমি?
তুমি পরেছ লাল টকটকে একটা শাড়ি।
যেটা কিনেছিলাম
ফেরিওলার কাছে,
এক টাকা চৌদ্দ আনায়।
গলায় হাঁসুলী, পায়ে মল,
গায়ের কোর্তাটা অনেক দামী –
মল্লিক বাজারে কেনা।
পায়ে তোমার নাগরাই সু
খোঁপায় চিরুণী আর অনেক কাঁটা,
তার ওপরে
একছড়া বেলফুলের মালা জড়ানো।
পথের লোকগুলো
হা ক’রে চেয়ে থাকবে তোমার দিকে।
তুমি যেন কিছু মনে করো না।
আমরা যখন হেঁটে যাবো-
আমরা বাহুটা জড়িয়ে থেকো
মেম সাহেবরা ঐ রকম চলে কিনা!
ফারপোতে আমরা যাব না।
খোদার দিন।
আজ নাছারা খানা খেতে নেই।
আমরা যাব ছকু মিয়ার হোটেলে।
বালুসাই, ছমুচা, খেজুর
যত তোমার খুশী খেয়ো।
ভাবনা নেই পয়সা আছে অনেক।
বাপ দিয়েছে ছ’আনা
দুই রাত বিড়ি বেঁধে পেয়েছি এক টাকা দু-আনা।
রাস্তায় বেরিয়ে
আরো কতক্ষণ ঘুরে বেড়াবো
নিরুদ্দেশে।
তারপর যখন বাজবে আড়াইটে
মনে পড়বে বায়স্কোপের কথা।
কোথায় যাব?
কেন ‘তসবির মহল’
না হয় ‘পার্ক শো হাউস’-
‘বাকে সেপাহীরা’ খেল আছে একটাতে
আর একটাতে ‘বাপকা বেটা’।
তখন আমরা রিকশতেই যাব।
তোমার একটা মান আছে তো!
আর তুমি যখন সাথে থাকবে
তখন টিকেটটাও না হয় চড়া দামেই নেব।
দু’খানা ন’আনাতে।
যদি ঘুমিয়ে যাও-
একটা জর্দা দেয়া পান
তোমাকে খাওয়াব।
তোমার ঘুম যাবে টুটে,
তোমার বুকের মধ্যে ধড়ফড় ক’রে উঠবে,
তুমি তখন আমার বুকে
মাথা রেখে খেল্ দেখবে।
আর তখন আমি পড়বো ঘুমিয়ে।
অনেক রাতে আমরা বেরুবো।
আবার রিকশ্।
তোমায় নামিয়ে দেব,
যে কোনো একখানে-
তুমি যাবে তোমার ঝরোকায়!
আর আমি?
আমি যাবো তিন নম্বর হারু মিয়ার বস্তি
সেখানেই আমি থাকি।
(রাত্রিশেষ, ১৯৪৭)
এক.
ঈদ নিয়া লেখা বাংলা-ভাষার সবচে সুন্দর কবিতা
কোন সন্দেহ ছাড়াই, ১৯৩১ সালে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতাটা হইতেছে বাংলা-ভাষায় ঈদ নিয়া লেখা সবচে সুন্দর কবিতা। (নিচে দিতেছি, লেখাটা পড়ার আগেও পইড়া নিতে পারেন।)
এইটা শুইনাই অনেক শিক্ষিত-বলদ ‘ভুল’ ধরতে আসবেন যে, এইটা তো কবিতা না, এইটা তো গান! এইখানেই কয়েকটা কথা বলার আছে আমার।
পয়লা কথা হইতেছে, গান ও কবিতার কেটাগরিটা নিয়া। আজকে যে, গানের লিরিকস এবং কবিতারে দুইটা কেটাগরি হিসাবে আমরা দেখি, এইটা বাংলা-ভাষায় মোস্টলি কলোনিয়াল পিরিয়ডের শেষের দিকের একটা ঘটনা। এর আগ পর্যন্ত বাংলা-ভাষার যত “কবিতা” আছে সবগুলা “গান” হিসাবেই পাইবেন; মানে, সুর কইরা গাওয়া হইতো, অই জিনিসগুলা। ওরাল ট্রাডিশনের ঘটনা বইলাই না খালি, বরং এইখানে গান ও কবিতা আলাদা দুইটা ঘটনা ছিল না। (কিছু একসেপশন তো পাওয়া যাইতেই পারে, কিন্তু আমি মেইন ট্রেন্ডের কথা বলতেছি।) যেইটা কবিতা সেইটাই গান, আর যেইটা গান, সেইটাই কবিতা – এইরকমের মিলমিশের একটা ঘটনাই ছিল। যেই কারণে রাধারমণ, হাছন রাজা উনাদেরকে কবি হিসাবে দেখতে পারতে হবে আমাদেরকে।
এরপরে যখন ইউরোপিয়ান ট্রাডিশনের “কবিতা” লেখা শুরু হইলো, “গান” জিনিসটা “কবিতা” হওয়া বন্ধ কইরা দেয় নাই, বরং আমরা কেটাগরি হিসাবে “গীতিকবিতা” ও তারপরে “গানের লিরিকস” পাইতে থাকি। এবং গান হিসাবে কবিতা লেখার ঘটনাও শেষ হয়া যায় নাই, বরং অই ফর্মগুলারে কবিতা বইলা মাইনা নিতে রাজি হইতে পারি নাই। এইটা গান’গুলার কবিতা না হওয়া না, আমাদের কেটাগোরাইজেশনের সমস্যা। যেই কারণে (বাউল) আবদুল করিম শামসুর রাহমানের চাইতে ইম্পর্টেন্ট কবি হওয়ার পরেও তারে রিকগনাইজ করতে আমরা রাজি না, বা শাহ আলম সরকার’রে ‘৮০/’৯০ দশকের কবি হিসাবে দাবি করলে উইয়ার্ড এবং ‘অযৌক্তিক’ মনে হইতে পারে!
তো, বাংলা-ভাষায় যখন গান ও কবিতা আলাদা জিনিস হইতে শুরু করলো তখনকার সময়ের কবি হইতেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। উনার গানগুলারে কবিতা হিসাবে দেখতে আমরা রাজি হইতে পারি না বইলা কবি হিসাবে উনারে এতোটা সিগনিফিকেন্ট মনে হইতে পারে না। এইটা হইতেছে আমার ফার্স্ট ক্লেইম। এই কেটাগোরাইজেশনের ব্যাপারে আমাদের ক্রিটিকাল হওয়াটা জরুরি।
দুসরা ঘটনা হইতেছে, যেহেতু এইটা পপুলার, এইটারে ‘আর্ট’ ভাবার ব্যাপারে একটু নারাজি আছে আমাদের। মানে, যেই জায়গা থিকা আর্টরে আমরা দেখি সেইখানে, আর্ট জিনিসটা তো কখনোই পপুলার হইতে পারে না! ফলে, এইরকম বিবেচনা বা ধারণার জায়গা থিকাও এই কবিতার নামটা কাটা যায়। ব্যাপারটা এইরকম না যে, পপুলার জিনিসও ভালো-আর্ট হইতে পারে, আর্টের বিপরীত পপুলার না, বরং পপুলারের বিপরীত হইতেছে কাল্ট। যেইভাবে আমরা আর্টের ঘটনাটারে দেখতে চাই, সেইখানে একটা ঝামেলা আসলে আছে, আর সেইটার এফেক্ট কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটারে রিড করার ব্যাপারেও জারি থাকে।
থার্ড আরেকটা ঘটনা হইতেছে, এখনো গান ও কবিতা পুরাপুরি আলাদা ঘটনা না। অনেক গানে কবিতা পাইবেন। বব ডিলান এর সবচে ভালো উদাহারণ। লেনার্ড কোহেনও। আরো অনেকেই আছেন, যাদের গানগুলা গান হওয়ার পরেও কবিতা। অই জায়গাটা আরো এক্সপান্ড করতেছে এখন। অই জায়গাটা থিকাও এই গানটা কবিতা।
মানে, আমি ঠিক যুক্তি-তর্ক দিয়া পরমাণ করতে চাইতেছি না যে, এইটা কবিতা! (এপারেন্টলি এইরকম মনে হইলেও।) বরং এই কবিতাটা পড়তে গিয়াই রিলিভেন্ট এই কথাগুলা মনে হইলো একভাবে।
অনেক কথা হইলো। 🙂 এইবার কবিতাটা পড়েন আবার!
…
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ,
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে,
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী,
সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ,
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
ঢাল হৃদয়ের তোর তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,
তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
তোরে মারল’ ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা,
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
…
Leave a Reply