বাংলাদেশি নিউজ-মিডিয়ার পলিটিকাল ইকোনমি – ইমরুল হাসান

বাংলাদেশের নিউজ-মিডিয়া মানে নিউজপেপার, টিভি-চ্যানেল, নিউজপোর্টালগুলার এভারেজ প্রফিট কতো টাকা? মানে, বছরে কতো টাকা লাভ করেন উনারা? যেহেতু উনারা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি না, এই হিসাবগুলা তো আমরা জানি না। তবে আমার গেইস হইতেছে, বেশিরভাগ-ই লস কনসার্ন। লস কইরাই উনারা উনাদের মালিকদের প্রফিট করায়া দেন।* [এই নিয়া ছোট একটা লেখা নিচে দিতেছি। কিছুটা ক্লিয়ার হইতে পারে ঘটনাটা, কি বলতে চাইতেছি আমি।]
[তবে “মালিক” ব্যাপারটা নিয়াও ক্রিটিকাল হওয়ার স্কোপ আছে। নিউজ-বিজনেস তো চাইল-ডাইল-তেল-সাবানের বিজনেস না, কিন্তু ওনারশিপের ঘটনাটা যদি একইভাবে কাজ করতে থাকে তাইলে সেইটা আলাদা কিছু হয়া উঠতে পারে না। নিউজ ব্যাপারটা এই জায়গাটা থিকা একটা কমোডিটি বা পণ্যই হয়া উঠতে থাকার কথা তখন।]
আচ্ছা প্রফিট বাদ দেন, ইনকাম সোর্সগুলা কি? পত্রিকা বেচা বা ভিউয়ার/সাব-স্ক্রাইবার থাকা? সার্কুলেশনের বা ছাপানোর ডেটা মোটামুটি ভুয়াই, সরকারি ডেটার মতন। যদ্দুর জানি, সার্কুলেশনের উপর বেইজ কইরা কাগজ আমদানি করতে পারেন উনারা, ট্যাক্স রিবেট পান; অই কাগজ বাজারে বেইচা দেয়াটা একটা মেজর ইনকাম সোর্স অনেক ‘নাম-সর্বস্ব’ নিউজপেপারের। আর বাংলাদেশের টিভি-চ্যানেল ভিউয়ার’রা তো মনেহয় ইউটিউবেই শিফট করছেন। এভারেজে কি রকম ভিউয়ার আছে একেকটা টিভি-চ্যানেলের? খরচ তোলার জন্য কি এনাফ? এইখানেও আমার সন্দেহ আছে।
তো, যেহেতু সাবস্ক্রাইবার নাই, ভিউয়ার নাই, প্রাইভেট কোম্পানিগুলার অ্যাডও পাইতে পারার কথা না তেমন। আমার আন্দাজ, না হইলেও ৭০% – ৮০% রেভিনিউ ফল করার কথা গত কয়েক বছরে নিউজপেপারগুলারের, টিভি-চ্যানেলগুলার। কারণ মানুশ যেইখানে বেশি কোম্পানিগুলা তো অইখানেই বিজ্ঞাপণ দিবে!
এই কারণে মাঝখানে অনেক পত্রিকার একটা সাইড বিজনেস ছিল কোম্পানিগুলার দুর্নীতি নিয়া রিপোর্ট করা। যেইটা এক ধরণের ইন-ডাইরেক্ট থ্রেট হিসাবে কাজ করতো। এর রেজাল্ট হইছে যে, বড় বড় সব কোম্পানিই নিউজপেপার, নিউজসাইট খুইলা বসছে। তা নাইলে কিছু টপ–লেভেলের সাংবাদিক কিইনা নিছে, যারা ডিসিশান-মেকার। নিউজপেপার, টিভি-চ্যানেলগুলার এই থ্রেট বরং ব্যাক-ফায়ারই করছে। তবে মফস্বল-সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘নতুন দিগন্ত উন্মোচন’ করছে!
তো, বাদ রইলো সরকারি-বিজ্ঞাপণ। অইটার জন্য তো মন্ত্রি-এমপি-সরকারিদলেরনতাদের পত্রিকাই তো আছে! অন্যরা কিছু ভাগ-টাগ পায়। আমার ধারণা, এইখানে একটা সিন্ডিকেট আছে।
মানে, আমি বলতে চাইতেছি, বাংলাদেশের নিউজ-মিডিয়ার বিজনেসে কোন প্রফিট নাই, ইনকামও কমতেছে। বিজনেস অর্গানাইজেশন হিসাবে এইগুলা খুবএকটা এগজিস্ট করে না; বরং সার্টেন পলিটিকাল এজেন্ডা ফুলফিল করতে পারে বড়জোর।
হিস্ট্রি ঘাঁটলে দেখা যাবে, নিউজপেপারের শুরু কোন না কোন পলিটিকাল আইডিওলজি প্রচারের জায়গা থিকাই। বা একটা কোর ফেনোমেনা তো ছিল ন্যাশনালিজম জাগায়া তোলা। এই উদ্দেশ্য এখনো আছে। কিন্তু নতুন মোড অফ কমিউনিকেশনগুলা চেইঞ্জ হইতেছে, ন্যাশনালিজমের মেকাপ তো খইসা পড়তেছে। তেমন বেচা-বিক্রি আর হয় না। সিরিয়াস হইতে গিয়া ব্যাপারগুলা ফানি-ই হয়া উঠে, বেশিরভাগ সময়।
নিউজ-পেপার, টিভি-চ্যানেল এবং নিউজ-পোর্টালের মেইন বিজনেস সিগনিফিকেন্স হইতেছে, যত না লস করে তার চাইতে বেশি লস দেখায়া মালিকের ট্যাক্স-বারডেন কমাইতে পারা। পলিটিকালি মেইন কাজ হইতেছে একটা পলিটিকাল দলের বা বড় বিজনেস গ্রুপের ব্যাক-আপ হিসাবে কাজ করা। কিন্তু এইসব কাজে তাদের ইনফ্লুয়েন্স কইমা আসতেছে। একটা সাইনবোর্ড হিসাবেই থাকতেছে বড়জোর। ফিউচারে এই খাতের খরচে আরো ভাগ বসাবে সোশাল-মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা। (হিরো আলমরে হেইট করার এইটাও একটা প্রাইমারি রিজন।)
মানে, আমি তো আমার আন্দাজ দিয়া কিছু জিনিস মার্ক করার ট্রাই করলাম। কিন্তু আমার ধারণা, কিছু ডেটা-টেটা দিয়া কাছাকাছি রকমের কিছু কনক্লোশনেই পৌঁছাইতে পারবো আমরা যে, ইন্ডিপেন্ডেড জার্নালিজমের বেইজটাই বাংলাদেশে মিসিং আসলে। এমন একটা স্ট্রাকচারের উপর পুরা ইন্ড্রাষ্ট্রি’টা দাঁড়ায়া আছে, যেইখানে কোন পলিটিকাল-দল বা বিজনেস-গ্রুপের “স্বার্থসিদ্ধি” ছাড়া কোন নিউজ-মিডিয়া হার্ডলি এগজিস্ট করার কথা এইখানে।
/এপ্রিল, ২০২৩
*
– বাংলাদেশের সাংবাদিকতা: একটা ইন্ড্রাষ্ট্রি ফেইলওর’রে ইন্ডিভিজ্যুয়ালের ক্রাইসিস হিসাবে হাইলাইট করার বিপদটা নিয়া –
আমাদের গ্রেট গ্রান্ডপা কার্ল মার্কসের অনেক কথাই আমি মান্য করি, তার মধ্যে একটা হইতেছে, যে কোন ইস্যুর ইকনোমিক আসপেক্ট’টারে খেয়াল করা।
এইটার কথা আবার মনে হইলো, বাংলাদেশের নিউজ-মিডিয়া বা সাংবাদিকতার জায়গাটারে অনেকে “বাধ্য হয়া” “চাকরি রক্ষার জন্য” “মালিকের গোলামি” করার জায়গা থিকা যখন ডিফেন্ড করার ট্রাই করেন, সেইটা দেইখা। তো, এইটা সত্যি কথা না। মানে, ব্যাপারটা এইরকম ‘সিম্পল ট্রুথ’র ঘটনা তো না-ই!
একটা ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমের মধ্যে বাঁইচা থাকতে হইলে নানা রকমের নেগোশিয়েশন আমাদেরকে করতেই হয়, ইন্ডিভিজ্যুয়াল লেভেলে; কিন্তু করাপ্ট হওয়াটা, ইভিল হওয়াটা যখন একটা প্রফেশনাল রিকোয়ারমেন্ট হয়া উঠে তখন সেইটা ইন্ডিভিজ্যুয়ালের ক্রাইসিস হিসাবে দেখানোটা
না-বুঝতে-পারা’র কোন ঘটনা না, বরং কোনকিছু লুকাইতে চাওয়ার ঘটনাই হওয়ার কথা।
তো, একটা ইন্ড্রাষ্ট্রির ক্রাইসিসরে ইন্ডিভিজ্যুয়াল ফেনোমেমা হিসাবে শো করার ভিতর দিয়া কোন জিনিসগুলারে লুকানো হয় আসলে? এইখানেই আমার কথাটা, যে, এর ইকনোমিক ইম্পর্টেন্সটারে ভুলভাবে দেখানো হয়। অনেকেই বলেন যে, একটা বিজনেস-গ্রুপ বড় হইলেই তার একটা পত্রিকা, টিভি-চ্যানেল লাগে, নিজেদের বিজনেস ইন্টারেস্ট প্রটেক্ট করার লাইগা। কিন্তু এইটা সেকেন্ডারি ঘটনা। মাঝে-মধ্যে কাজে লাগে, কিন্তু সাংবাদিক পালতে হইলে নিউজপেপার, টিভি-চ্যানেল খোলার দরকার নাই তো এতোটা, টাকা-পয়সা দিলেই তো হয়! রিস্কও কম।
নিউজপেপার, টিভি-চ্যানেলের সবচে বড় ইকনোমিক বেনিফিট হইতেছে ‘কালা-টাকা’ শাদা করা। এইগুলা যেহেতু পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি না, এদের কোম্পানি ফিনান্সিয়ালস আমরা জানি না, কিন্তু ট্যাক্স ফাইল থাকার কথা, সেইখানে পাওয়া যাবে, এরা কতো কোটি টাকা লস দেয়, বছর বছর। যদি ১০ কোটি টাকা লস দেয়, সেইটারে ১০০ কোটি টাকা দেখায়া ৯০ কোটি ব্ল্যাক-মানি হোয়াইট করতে পারার কথা, অন্য বিজনেসগুলার। এইটা হইতেছে মেজর ইকনোমিক বেনিফিট বাংলাদেশে, মিডিয়া-বিজনেসের।
এইটা সাংবাদিকরা জানেন না – এইটা আমার কাছে মনেহয় না। কিন্তু এইটা নিয়া কথা কইলে নিজেদের ভারনারিবিলিটিরে গ্লোরিফাই করাটা তো মুশকিলই হয়।… মানে, আমি বলতে চাইতেছি, সাংবাদিকরা তাদের নিউজ-টিউজের ভিতর দিয়া তাদের মালিকদেরকে এতোটা ইকনোমিক বেনিফিট দিতে পারতেছেন না, যদি পারতেন, উনাদের মান-সম্মান আরেকটু বেশি থাকার কথা। উনারা হইতেছেন একটা কাভার-আপ, মোস্টলি। (ধরেন, মুদির দোকানে মদ-বেচার মতো। মুদির দোকানের সাইনবোর্ডটা লাগে তো। এইরকমের একটা ঘটনা।) সাংবাদিকতা কইরা যদি মালিকরে লাভ দিতে পারতেন তাইলে কিছুটা বার্গেইনিং পাওয়ার থাকতো উনাদের। (যারা পারেন, তাদের আছে বইলাই মনেহয় আমার।) যেইটা এখন নাই এখন।
তবে এইটাই একমাত্র ঘটনা না। অন্য আরো জিনিস তো আছেই – একটা কালচারাল-ক্যাপিটাল গেইন করা, পলিটিক্যালি পাওয়ারফুল থাকা, ‘আধুনিক হওয়া’ পার্টি-সার্টি, গ্ল্যামার-ফেইম এভেইল করতে চাওয়া, নানান রকমের এজেন্ডা এইখানে আছে। কিন্তু অই তো, ইকনোমিক জায়গাটারে লোকেট না করতে পারলে অন্য অনেককিছুরেই ঠিকমতো রিড করতে পারবো না আমরা।
/অগাস্ট, ২০২২
Leave a Reply