মানুষের ন্যাচারাল রাইটস নিয়ে দরকারি বুঝ – আরিফ হোসেন

১৯২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১৭ বছর বয়সী ক্যারি এলিজাবেথ বাক ধর্ষিত হয়। এর ফলে ১৯২৪ সালের জানুয়ারী মাসে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। এলিজাবেথকে দত্তক নেয়া পরিবার তাকে Virginia Colony for Epileptics and Feeble-Minded এ ভর্তি করায়। তাদের যুক্তি ছিল ক্যারি বাক মানসিক প্রতিবন্ধী, এবং তার অন্যতম ফলাফল হচ্ছে Promiscuity।
ঐসময়ে মানসিক রোগকে “বংশগত” মনে করা হত। সুতরাং তাদের বংশ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বাধা দেবার দরকার আছে বলে অনেকেই মনে করতেন। যুক্তরাষ্ট্রের “রেসিয়াল হাইজিন” রক্ষার জন্যে বিভিন্ন যায়গায় গঠিত হয় “ইউজেনিক্স” সোসাইটি। এরা শুধুমাত্র সিলেক্টিভ ব্রিডিং ই উতসাহিত করত না, সেই সাথে মানসিক রোগী, অপরাধী, মদ্যপ ইত্যাদি মানুষদের সমাজথেকে আলাদা করে দেবার জন্যে আইন প্রণয়নের কথা বলত।
বংশবৃদ্ধি বাধা দেবার জন্যে বিভিন্ন উপায়ে স্টেরালাইজেশনের কথা অনেকেই বলতেন। কয়েকজন এক্সট্রিম ইউজিনিক্স এর সমর্থক গ্যাস চেম্বারের মাধ্যমে “যন্ত্রনাহীন” হত্যার কথাও বলতেন। যারা এইসব লবিং এ জড়িত ছিলেন তাদের অনেকেই ছিলেন বিজ্ঞানী। বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন, আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে রেসিস্ট প্রেসিডেন্টদের মধ্যে একজন, ছিলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট এবং বিখ্যাত স্কলার, তার সময়ে এই মুভমেন্ট প্রচুর গতি পায়। সেনাবাহিনীতেও বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে মানসিকভাবে পিছিয়ে পরা মানুষ খুজে বের করা এবং তাদের সমাজ থেকে আলাদা করে ফেলার প্রক্রীয়া তৈরী হয়।
বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট হেনরি গডার্ড এর The Kallikak Family, এই সামাজিক আন্দোলনের বাইবেলে পরিণত হয়। অনেক স্টেইটে আইকিউ টেস্টের মত পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের জোড় করে স্টেরালাইজ করার আইন পাশ করা হয়। ১৯২৪ সালে জেলে বন্দী অবস্থায় হিটলার এই বইটি পড়ে এবং পরে এই বইটি নাজি প্রপাগাণ্ডার অন্যতম প্রধান উপকরণ ছিল। রাষ্ট্রীয় খরচে এর জার্মান ট্রান্সলেশন বের হয়, এবং নাজি পার্টির ইউজেনিক্স সংক্রান্ত সকল প্রোপাগাণ্ডায় এই বইয়ের ব্যবহার হয়।
এই প্রেক্ষাপটেই ভার্জিনিয়া কলোনি, ক্যারি বাকের স্টেরালাইজেশনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে ক্যারি বাক স্টেরালাইজেশন অপারেশন যেই ডাক্তার করেছিলেন, বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন, এবং সেই মামলা ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট, আপিল কোর্ট ঘুরে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টে এসে পৌছায়। আমেরিকার ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত প্রোগ্রেসিভ বিচারপতি, অলিভার উইন্ডেল হোমসের কোর্ট ১৯২৭ এ এই মামলা গ্রহন করেন। ঐসময়ে ফোর্সড স্টেরালাইজেশনের আইন অনেকগুলো স্টেইটেই ছিল। সুতরাং এই মামলার রায়ের উপর যুক্ত্রারাষ্ট্রের পুরো ইউজেনিক্স মুভমেন্টের ভাগ্য নির্ভর করছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, এইভাবে নাগরিকের সিভিল রাইটস কেড়ে নেয়া যায় কিনা, তাই প্রধান প্রশ্ন ছিল এই মামলায়।
আপীলকারীর মূল যুক্তি ছিল এইধরনের ফোর্সড স্টেরালাইজেশন সংবিধানের ডিউ প্রোসেস ক্লজ এবং ইকুয়াল প্রোটেকশন আণ্ডার ল ক্লজকে ভায়োলেট করে।
দুঃখজনভাবে কোর্ট ৮-১ ভোটে এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে, এবং ভার্জিনিয়ার ফোর্সড স্টেরালাইজেশন আইনকে সাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করে। মেজরিটি অপিনিয়নে বিচারপতি হোমস বলেন,
“We have seen more than once that the public welfare may call upon the best citizens for their lives. It would be strange if it could not call upon those who already sap the strength of the State for these lesser sacrifices, often not felt to be such by those concerned, to prevent our being swamped with incompetence. It is better for all the world, if instead of waiting to execute degenerate offspring for crime, or to let them starve for their imbecility, society can prevent those who are manifestly unfit from continuing their kind. The principle that sustains compulsory vaccination is broad enough to cover cutting the Fallopian tubes.”
যুক্তিটি পরিচিত লাগছে? এটি সেই বহু চর্চিত পুরাতন যুক্তি “বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্রতর স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া”। এই যুক্তিটি বস্তাপচা এবং বিপদজনক, কারন বৃহত্তর স্বার্থটি কি হবে, সেটি সাধারনত নির্নিত হয় কারো উপর অন্যায়/অবিচার র্যাশনালাইজেশনের মাধ্যমে। ফলে এই যুক্তির ফলাফলে সবসময়েই কারো না কারো অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। এই যুক্তিকে বর্জন করা নাগরিকের এক নম্বর দায়িত্ব।
যাই হোক, একমাত্র দ্বিমত ছিল জাস্টিস বাটলারের।
এই ভয়ংকর রায় শেষ পর্যন্ত বাতিল হয় ১৯৪২ এ Skinner v. Oklahoma মামলায়।
ইউজেনিক্স আন্দোলন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রোগ্রেসিভ যুগের আরো বেশ কয়েকটি সংস্কার আন্দোলনের মতই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ব্যবহার করে জনগনকে নিয়ন্ত্রন করাকে যৌক্তিক এবং গ্রহনীয় মনে করতেন। এই সকল সংস্কার আন্দলোনের সাথে অনেক বিজ্ঞানী, তাদের মাঝে বেশ কয়েকজন নোবেল বিজয়ীও ছিলেন, জড়িত ছিলেন। তারা মনে করতে বিজ্ঞানের ব্যবহারের মাধ্যমে জনগনের উন্নতি, যদিওবা সেটা জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়, তাও উচিত। এইকারনে এরা সবাই যাকে বলে “ইল্লিবারেল” ছিলেন। তারা ডেমোক্র্যাসি সম্পর্কে খুব একটা উচ্চ ধারনা রাখতেন না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এরা সকলেই কল্যান রাষ্ট্রের পক্ষপাতি ছিলেন, এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নাগরিকদের জীবনের উন্নতি তাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ক্ষমতার ব্যাপারে তারা নাগরিকদের অংশগ্রহনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন, এবং তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের উভয় রাজনৈতিক দলেই যাতে তাদের সমর্থক থাকে। যাতে কংগ্রেস অথবা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলে তাদের সংস্কারকার্য বাধাগ্রস্ত না হয়।
.আধুনিক ভাষায় “টেকনোক্র্যাসি” বলে যেই বিষয়টি প্রচলিত আছে, অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব ছেড়ে দিবেন অনির্বাচিত “এক্সপার্ট” দের হাতে, এই প্রবণতার শুরু অনেকাংশেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রোগ্রেসিভ রাজনীতির এই যুগে।
এই ফাকে দুইটি বইয়ের রিকমেণ্ডেশন দিয়ে নেই, যা এই বিষয়ে বিশদ জানতে সাহায্য করবে,
[১] Illiberal Reformers: Race, Eugenics, and American Economics in the Progressive Era, Thomas C. Leonard
[২] She Has Her Mother’s Laugh, Carl Zimmer
বঙ্গদেশের সেক্যুলার বুদ্ধিজীবিকূল স্কোপস ট্রায়াল( The State of Tennessee v. John Thomas Scopes) এর গল্প শুনিয়ে আমাদের যেই বিজ্ঞান বনাম রক্ষণশীলতার ন্যারেটিভ শোনায় সেটা শুধু অসত্যই না, নিম্নমানের প্রোপাগাণ্ডা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়টা পুরো পৃথিবী জুড়েই বিজ্ঞান ক্ষমতার অংশীদার ছিল, প্রচুর আইন বৈজ্ঞানিক কমিউনিটির প্রত্যক্ষ লবিং এবং এক্টিভিজমের মাধ্যমে হয়েছে। বৈজ্ঞানিকরা নিয়মিত কোর্টে এক্সপার্ট অপিনিয়ন দিয়েছেন, সুপ্রীম কোর্টে এমিকাস ব্রীফ দিয়েছেন, কঙ্গগ্রেশনাল টেস্টিমনি দিয়েছেন। তারা কোনভাবেই “রিপ্রেসড” ছিলেন না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
এই গল্পের মূল অর্থ হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা/শিক্ষা ইত্যাদি মানুষকে গনতন্ত্রপন্থী করে তোলে এমনটা ইতিহাস শিক্ষা দেয় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষিত মানুষ, অশিক্ষিতদের অধিকারের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে।
বঙ্গদেশে এমনটাই প্রচলিত আছে, যে অশিক্ষিত চাষাভূষা ব্যক্তিবর্গ এইসব অধিকারের কচকচানি কেয়ার করে না। তাদের খেতে/পরতে পারলেই হল। মজার বিষয় হচ্ছে এইসব মতামত আপনি চাষাভূষার কাছ থেকে পাবেন না। এইখানে শিক্ষিত মানুষের স্নবারির প্রমান হিসেবে, শিক্ষিত মানুষ গরীব/অশিক্ষিতের “হয়ে” কথা বলার প্রবণতা চলে এসেছে। আপনার কি মনে হয়, একজন কৃষককে যদি অপশন দেয়া হয়, সে এবং তার পরিবারের সকল চাহিদা মোটামুটি পূরণ করা হবে, বদলে সে জেলে থাকবে, কয়জন কৃষক এইটাতে রাজী হবে? কৃষককে ওয়ারেন্ট ছাড়া ধইরা নিয়ে গেলে সে কি খুশী হবে যদি তার পেটে ভাত থাকে? কৃষক যদি বাজারে গিয়ে তার এলাকার ফাউল লোকজনের নিন্দা না করতে পারে, তাইলে তার ভালো লাগবে?
সিভিল রাইটসের অধিকাংশকেই ক্লাসিক্যাল লিবারেলরা বলতেন “ন্যাচারাল রাইটস”। অর্থাৎ এইগুলো কাউকে শিখাতে হয় না। একজন মানুষের বলার ইচ্ছা, তার নিজের বাসায় নিরাপদ থাকার ইচ্ছা, ইত্যাদি মানুষের প্রকৃতির সাথে অঙ্গাওঙ্গিভাবে জড়িত। এইগুলো শেখার জন্যে বা এই অধিকার চাওয়ার জন্যে কাউকে ঢাউস ডিগ্রী অর্জন করতে হয়।
মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীন, প্রকৃতিগতভাবেই “ডেমোক্র্যাট”, গনতন্ত্রপন্থী। ক্ষমতার অসাম্য তার ইচ্ছাকে বাধা দিতে পারে, তার অর্থ এই নয় সে গনতন্ত্রপন্থী নয়।
মুষ্টিমেয় মানুষ থাকে যারা অন্যের এই অধিকার স্বীকার না করলেও নিজের জন্যে এই অধিকার স্বীকার করেন। সবচেয়ে বড় ক্রিমিনাল ফ্যাসিস্ট ছাত্রলীগের পাণ্ডাও মুখে কুলুপ এটে বসে থাকতে চাইবে না, চাইবে না ক্রসফায়ারে মারা পরতে।
যারা এই অধিকারের প্রশ্নে “কন্ডিশনাল” তারাই গনতন্ত্রের বড় শত্রু। এইসব ব্যাপারে আমাদের এইখানে অনেক ট্যাবু আছে। সেইগুলো ভাঙ্গা প্রয়োজন যদি প্রকৃত “গভার্নমেন্ট বেইজড অন কনসেন্ট অফ দ্যা গভার্নড” আমরা তৈরী করতে চাই। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউনাজিদের বাকস্বাধীনতার পক্ষে লড়েছিল। আপনিও তখনই উদারনৈতিক গনতন্ত্রপন্থী হতে পারবেন, যদি পারেন আপনার রাজনৈতিক শত্রুর সিভিল রাইটসের ব্যাপারে এগিয়ে আসতে।
অধিকারের ব্যাপারে আনকণ্ডিশনাল থাকে, এই নীতি এবং ন্যায্যতা আগে আদায় করে নেন।
কল্যান রাষ্ট্রের বিষয়াদি সেকেণ্ডারি। যদি প্রথমটা নিশ্চিত করা যায়, দ্বিতীয়টা তাহলে হবে বেনেভলেন্ট। অন্যথায় কল্যান রাষ্ট্রের নামে “সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং” হবে , অধিকারের উপর ছুড়ি চালানো হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রে শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাসের লোকজনকে জায়গা দেয়ার মাধ্যমে একধরনের সোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইতমধ্যেই শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ডমিনেন্ট ন্যারেটিভে আপনার আস্থার পরিমাণ যদি আপনার সম্মান/স্ট্যাটাস/অধিকারের পরিমানের নির্নায়ক হয়ে উঠে, তাইলে আর যাইহোক রাষ্ট্র বা সমাজ লিবারেল থাকে না। লিবারেল সমাজে ইতিহাস পাঠ প্রয়োজন, কিন্তু ফেটিশাইজেশন অপ্রয়োজনীয়, অনেকক্ষেত্রে বিপদজনক।
কথিত আছে, যদিও প্লুটারকের মত ভিন্ন, যে জুলিয়াস সিজারকে ছুড়ি মারার পরে ব্রুটাস বলেছিলন “Sic semper tyrannis”(“thus always to tyrants.”) । মানুষ কোনওকালে রাস্তাঘাট আর ভরা পেটের জন্যে অনন্তকালের জন্যে টাইরেনি সহ্য করে নাই। ভবিষ্যতেও করবে না।
Leave a Reply