রাজকুমার, কাজলরেখা, পাবলিক ও তাদের চাহিদা

Share

রোজার ঈদে মুক্তি পাওয়া কাজলরেখা দেড় মাস পর বগুড়ায় মুক্তি পাইছে গত শুক্রবার, ২৪ মে। দেরি না কইরা সেইদিনই দেইখা আইলাম সিনেমাটা। ভাবছিলাম ঈদেই হয়তো মুক্তি দিবে কাজলরেখা। কিন্তু ঈদে শাকিব খানের রাজকুমার মুক্তি দিছে। পাবলিকের চাহিদা বুইঝা। খারাপ না। দিতেই তো পারে।

ঈদে সবাই মিইলা পরিবার নিয়া রাজকুমার দেখতে গেছিলাম হলে। আমি, আমার বউ, শালা, শালী, বড় আপা আর আপার ছেলে। আমরা গেছিলাম বোধহয় ঈদের সপ্তাখানেক পরে। তখন দর্শক তেমন নাই। ৪০/৫০ জন হবে। বেশিরভাগই ইয়াং ছেলে মেয়ে। সবাই দল বাইন্ধা আসছে। একদল আসছিল শুধু হাসতে। তাদের কাজ হচ্ছে হাসা। মজা নেওয়া। সিনেমা দেখতে তো মানুষ মজা নিতেই যায়। মজা তো নিবেই। আমরাও যে মজা নেই নাই বা হাসি নাই তা না। কিন্তু, এইখানে একটা কিন্তু আছে। সেইটা না হয় পরে বলা যাবে। আগে কাজলরেখার কথা বলি।

এক কথায় বলতে গেলে গিয়াস উদ্দীন সেলিম ভালো একটা সিনেমা বানাইছেন। যেইটা শেষ পর্যন্ত আমাদের আগ্রহ ধইরা রাখতে পারছে। সবার অভিনয়, পরিচালকের নির্মাণ-কৌশল, লোকেশন, সংলাপ, গান, ব্যাকগ্রাউন্ড-মিউজিক, সব মিলায়া দারুণ একটা কাজ ছিল, দর্শকদের উঠতে দেয় নাই। বরং আগ্রহে আগায়া বসছিলাম এরপর কী হয় এরপর কী হয় দেখতে। যেহেতু আমি কাজলরেখা পড়ি নাই বা এর গল্পটা জানা ছিল না, এই জন্য বোধহয় বেশি মজা পাইছি। আমি শিওর যে গল্প জানা থাকলেও সিনেমাটা কেমন হইছে তা হলে গিয়া দেখতাম এবং তখনো আনন্দের ঘাটতি হইতো না। হয়তো তখন ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা মাথায় আসতো।

একটা ভালো সিনেমার কী কী গুণ থাকতে হবে তা নিয়া আমার তেমন জানাশোনা নাই। তবে একজন সিনেমাখোর হিসাবে যেইটা মনে হয় গল্প, চরিত্র, গান, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, ডিটেইলের প্রতি খেয়াল রাখা, ভালো সমাপ্তি থাকতে হবে। এমন মুভি ভালো মুভি হিসাবে মানতে অসুবিধা থাকার কথা না। সবথেইকা বড় কথা ছবিটার কথা ভুলতে কতদিন লাগতেছে। যদি মাঝেমধ্যে মনে পড়ে, তা নিয়া ভাবনা খেলা করে, বিভিন্ন সময় রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা যায়, সেইটা ভালো মুভি হওয়ার চান্স বেশি। মুভি দেখার পর থেইকাই যদি মুভির গান গল্প নিয়া আলাদা গল্প তৈরি হয়, হলে শুইনা আইসা গানগুলি যদি পরপর বাজাইতে হয়, তাইলে সেইটাকে ভালো মুভি না বইলা পারা যায় না। কাজলরেখা দেইখা আসার পর থেইকাই মুভির গানগুলি শুনতেছি। দিনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মুডে একেক গান বাজাইতেছি। হালকা মন খারাপ থাকলে ‘হলুদ রে তুই কোন কোন কাজে লাগিস’, ‘বাপ মোর কই লইয়া যাও গো’, ‘কেমন কইরা মন কাড়িবো’, শোনা যায়। মুড ভালো থাকলে, ‘কী কাম করিল সাধু’, ‘ঘুমাইলা ঘুমাইলা রে সাধু’, আর ফানি মুডে থাকলে ‘কইন্না আঁকে গো আল্পনা’ শোনা যায়।
সবকথার বড় কথা কাজলরেখার গল্পটাই এই সিনেমার সবথেইকা বড় শক্তি। গল্পটা নিছেন মৈমনসিংহ গীতিকা থেইকা। কাজলরেখা আমাদের গল্প, কাজলরেখা বাংলাদেশের রূপকথা। কাজলরেখা কে লিখছেন সেই ব্যাপারে তেমন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এই রূপকথা সংগ্রহ করছেন চন্দ্রকুমার দে। তিনিই মৈমনসিংহ গীতিকার সবগুলি কাব্য সংগ্রহ করছেন। কিন্তু উনার নামটা তেমন শোনা যায় না। আমরা দীনেশচন্দ্র সেনের কথাই জানতাম এতদিন। যদিও এই ভদ্রলোক চন্দ্রকুমার দের কথা ভুইলা যান নাই। তার কথা সবার আগে স্মরণ করছেন।

কিন্তু কাজলরেখা এখন যতটা গর্বের সাথে আমাদের রূপকথা আমাদের গল্প বলতে পারি, ততটা গর্ব করার বিষয় যে এইসব না তা ‘শিক্খিত পাবলিক’রা আমাদের আগেও স্মরণ করায়া দিছেন। এখনও যেমন হলে গিয়া শুধু বাংলা সিনেমা বইলাই হাসাহাসি করা হয়।

ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেন জানাইতেছেন, “আমি মৈমনসিংহের অনেক লোকের নিকটে জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু কেহই তথাকার পল্লীগাথার আর কোন সংবাদ দিতে পারিলেন না। কেহ কেহ ইংরাজী শিক্ষার দর্পে উপেক্ষা করিয়া বলিলেন, “ছোটলোকেরা, বিশেষঃত মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাহিয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কি থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ তৎপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন? আপনি এই ছেঁড়া পুথি ঘাঁটা দিন কয়েকের জন্য ছাড়িয়া দিন।”

ছবি দেখার পর মনে হইলো, এই সিনেমা তো সুপার হিট হওয়ার কথা। কিন্তু দর্শকদের যে অবস্থা তাতে সুপারহিট তো দূরের কথা আসল টাকাই তো ওঠার কথা না। যদিও সিনেমাটা সরকারি অনুদান পাইছে।

এই সিনেমা হিট না হওয়ার বড় কারণ কী হইতে পারে ভাবতেছিলাম। সরকারি টাকায় বানানো বইলা প্রচার কম করা হইছে? নাকি নায়ক নায়িকা তেমন বিখ্যাত না বইলা? হলের মালিকরাও তেমন পাত্তা দেয় নাই। পাবলিকের চাহিদা কম বইলা হয়তো। এই সিনেমার নায়ক নায়িকাদের কাটআউট বানানো হয় নাই। ছবি তোলার জায়গাগুলিতে এখনো শাহরুখ খান আর শাকিব খানের কাটআউট আছে। কিন্তু হলে চলতে থাকা মুভির তেমন পোস্টারও বানানো হয় নাই। নাকি গল্পটা ছোটলোক চাষাদের গল্প বইলা পাবলিকের চাহিদা তেমন হয় নাই?
সিনেমা যে হিট হবে, থানা পর্যায়ের তো আর কোনো হলই নাই। মানুষ দেখবে কোথায়! জানেও না কাজলরেখার কথা। হল থাকলে, ঠিকমতো প্রচার করলে রূপবান, বেহুলা লক্খিন্দর কিংবা বেদের মেয়ে জোছনার মতো না হইলেও ভালো রকম একটা ফ্রুটফল যে হইতো তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

এই ঈদে মুক্তি পাওয়া দুইটা মুভিতেই একটা জায়গায় মিল আছে। সেইটা হচ্ছে প্রিয়জনের ভালো চাইতে বিরাট একটা ত্যাগ স্বীকার করা। রাজকুমারে মাও বেটার সঙ্গে কথা বলে না। আর কাজলরেখায় রাজাকে নিজের পরিচয় দেয় না রাণী। দুইটাতেই প্রিয়জনের অমঙ্গলের আশঙ্কায় ত্যাগ স্বীকারের ঘটনা ঘটে। অমিলের জায়গা হইলো, কাজলরেখায় শেষ পর্যন্ত রাজারে পায় রাণী। কিন্তু রাজকুমারে মায়ের সঙ্গে দেখা হইলেও নায়ক মারা যায়।

কাজলরেখা দেখতে গিয়া একটা মজার ঘটনা ঘটছে, যেইটা না বইলা পারা যাইতেছে না। সিনেমার যখন বিরতি লেখা ওঠে তখন মাত্র ১ ঘণ্টা হইছে। কিন্তু আমাদের হলটাতে সেই সময় বিরতি দেয় নাই। ওরা আরও ১৫ মিনিট পরে বিরতি দিছে। সম্ভবত তাদের নিয়ম মাইনা এইটা করছে। পরিচালক সিনেমার এমন জায়গায় বিরতি দিছেন, রাণী আর দাসী যেইখানে বদল হয়া যায়, দাসিরে রাণী বানায়া রাজা যখন বাড়ি বিইলা রওয়ানা দেয়, যেইখানে আগ্রহের মাত্রাটা চরম লেভেলে আছে। কিন্তু হলের দায়িত্বে যারা আছে তারা সেই জায়গায় বিরতি না দিয়া, আরও ১৫ মিনিট পরে বিরতি দিছে। ফলে আমরা দর্শকরা দোটানায় পইড়া গেছিলাম। প্রথমবার যখন বিরতি লেখা উঠল পর্দায়, তখন আমরা বাইর হওয়ার জন্য উঠতে ধরছিলাম। কিন্তু সিনেমা চলতে থাকায় হালকা বিরক্তি নিয়া আবারও সিনেমা দেখতে বইসা গেলাম। কিন্তু ১৫ মিনিট যাইতেই সিনেমা পজ কইরা দিল। তখন আবার উঠতে ইচ্ছা করতেছিল না কারোরই। মানে সিনেমায় আমরা এনগেইজড হয়া গেছিলাম। ভাবতেছিলাম এখন আর বিরতি না দিলেও পারত।

তো এই সময় ঘটল আরেকটা ঘটনা। বিরতির সময় বাইরে গিয়া কিছু কিনব বইলা রাস্তায় গিয়া দেখি কোনো দোকান খোলা নাই। আমাদের পাশে যেই দম্পতি বইসা ছিল তাদেরও রাস্তায় যাইতে দেখলাম। দোকান খোলা না থাকার পরেও তারা আরও সামনে যাইতেছিল। ভাবলাম, হয়তো তারা আবার ফিইরা আসবে। আমি আর সামনে গেলাম না। আইসা আমরা আবার সিনেমা দেখা শুরু করলাম। কিন্তু তারা আর ফিইরা আইল না।

এখন আসি সিনেমার সমস্যা নিয়া। মোট কথায় কাজলরেখায় তেমন সমস্যা নাই। বাজেট কম থাকার কারণেই হোক আর লোকেশনের অভাবে হোক, একই দৃশ্য বারবার দেখাইছে পরিচালক। এতে করে কিছুটা বিরক্ত লাগছে।

গল্পেও হালকা সমস্যা আছে বইলা মনে হইলো। যদি সেইটাকে সমস্যা বলা হয় আরকি। সিনেমার প্রথম অংশে, নায়িকার অল্পবয়সী সিনে সাদিয়া আয়মানকে রাখা হইছে। সাদিয়া আয়মান ভালো অভিনয় করছে। কিন্তু দ্বিতীয় অংশে ভরা যৌবনে মন্দিরা চক্রবর্তীকে রাখা হইছে। মন্দিরার চেহারা সুন্দর। নায়িকাসুলভ। দেহও আকর্ষণীয়। দাসির চরিত্রে অভিনয় করছেন মিথিলা। মিথিলা এইখানে খুব ভালো অভিনয় করছেন। তার স্বভাব কুটনা টাইপের। টক্সিক।

মন্দিরা চক্রবর্তীকে রাখা নিয়া আমার যেইটা মনে হইছে, দাসি আর রাণীর সৌন্দর্যর পার্থক্য বুঝাইতে এইটা করা হইছে। মানে, নায়িকা যদি দাসীর থেইকা বেশি সুন্দর না হয়, তাইলে তো হইলো না কিছু। সিনেমাতেও সেই কথায় বলা হয়, তোমার রূপে (মানে ধলা চামড়া) আর গুণে তো মনে হয় না তুমি দাসী বা গরীব ঘরের মেয়ে। তুমি নিশ্চয়ই কোনো রাজার মেয়ে হবা। কম করে হইলেও সওদাগরের মেয়ে হবা। যেন রূপ আর গুণ ধনীদের নিজস্ব সম্পত্তি। এই জিনিস গরীবের না।

যদিও আমি ভুইলা যাই নাই যে এইটা ৪০০ বছর আগের সমাজের গল্প। কিন্তু পরিচালককেও যেই কৌশলের আশ্রয় নিতে হইলো তা ভাবতে বাধ্য করছে আরকি।

এমন হইতে পারে যে, ধনীর ঘরে রূপ নিয়া জন্ম নিলে সেই রূপের কদর থাকে, সেইটা ধইরা রাখার বা আরও সুন্দর করার ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু গরীবের তা থাকে না। হইতেই পারে।

কিন্তু গুণটার ব্যাপারে কী বলা যায়? গুণ তো গরীবেরও হয়। তরকারি স্বাদ কইরা গরীবের মেয়ে বা বউও রান্না করতে পারে। লবণ কম বেশি দেওয়া কমনসেন্সের বিষয়।

আর ভালো খারাপ তো সবাই হইতে পারে। কিন্তু গরীবকেই খারাপ দেখার এই প্রবণতা, বা গুণ উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া আমাদের। ২০২৪ সালেও সেই গুণ আমরা ধইরাই রাখছি, এই হইলো বিষয়।

মিথিলাকে হারামির চরিত্রে দেখতে পারাটা দর্শকদের জন্য ডাবল বোনাস। তাহসানের সাথে ডিভোর্স হওয়া আর কলিকাতায় গিয়া বিয়া করা, মেয়ে যেহেতু, তার উপর চরিত্রের দোষ! সুতরাং তার এই হারামির চরিত্র আর শেষ পরিণতি একস্ট্রা বিনোদন বা মজা দিছে দর্শকদের। মিথিলার শাস্তিতে সবাই উচ্চ হাসিতে মাইতা উঠছিল।

হাসাহাসি করা ভালো। স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কিন্তু কোথায় কখন হাসা হচ্ছে তা নিয়া ভাবা দরকার।

এইবার আসি শাকিব খানের রাজকুমার দেইখা হাসাহাসিতে। রাজকুমারে শাকিব ভালো অভিনয় করছে। তার যে অতি অভিনয়ের রোগ, সেইটা এইখানে ছিল না। গল্পটাও মোটামুটি ভালো ছিল। শেষে আইসা একটু ঝামেলা পাকায়া ফেলছিল। সব মিলায়া হাসাহাসির তেমন সুযোগ ছিল না।
তবু হাসতে হইলো। সারা মুভিতেই প্রচুর কথাবার্তা বলতেছিল সেই হাসাহাসির দল। যেহেতু তারা হাসতেই আসছে, যে শাকিব খানের সিনেমা চলতেছে, চল যাই একটু হাইসা আসি। অভিনয় ভালো হইলে কী হবে, গল্প ভালো হইলে কী হবে, শাকিব খান যেহেতু, আর বাংলা সিনেমা—হাসা যায়।

এই দর্শকরাই কিন্তু শাহরুখ খানের সিনেমা দেইখা হাসে নাই। বরং আনন্দে হাততালি দিয়া উঠছে পাঠানে জওয়ানে। এমন না যে শাহরুখ খানের অভিনয় খুবই উঁচা মাপের। বা তার অতি অভিনয় নাই। গল্পও যে খুব আহামরি কিছু এমনও না। সেই বস্তাপচা গল্পই। কিন্তু বিদেশী সিনেমা যেহেতু, আর যেহেতু গোলামির শত বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে, অতএব হাসা যাবে না। সম্মান করতে হবে। শাহরুখ খানের এন্ট্রিতে দাঁড়ায়া যাইতে হবে!

আবারও রাজকুমারে আসি। বলতেছিলাম ওই সিনেমার শেষে আইসা ঝামেলা পাকায়া ফেলছিল। নায়িকা মাহিয়া মাহি শাকিব খানের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করছে। অল্প বয়সের সিনগুলাতে ভালো অভিনয় করছে। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সের মেকাপটা তার ভালো হয় নাই। এতটাই খারাপ ছিল যে, শেষ সিনে যখন শাকিব খানকে গুণ্ডারা গুলি করে আর তার মাও তার সামনে আসে, তখন আমার বারো বছর বয়সী সেই ভাইগন্যা বইলা বসছিল, গুলি খায়া বাঁচার আশা থাকলেও মায়ের চেহারা দেইখাই আরও মইরা গেছে শাকিব খান!

হুসাইন হানিফ

হুসাইন হানিফ প্রকাশিত বই: বহিষ্কার (গল্পগ্রন্থ, জানুয়ারি ২০২৩) জন্ম: ১৯৯৯ সারিয়াকান্দি, বগুড়া

  • May 28, 2024