আর্ট এজ এন সোশিও-পলিটিকাল প্রডাক্ট: এ.আর. রহমানের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট…’-এর ফেইলওর

আমার ধারণা, এ, আর. রহমানের সুরটা শুনলে কাজী নজরুল ইসলাম মোটেই খেপতেন না, বেশি হইলে একটু হাসাহাসি করতেন, এর বেশি কিছু না। এইটা মনে হওয়ার কারণ হইতেছে কাজী মোতাহার হোসেনের একটা অবজারভেশন। (কোটেশনটা লেখার শেষে রাখতেছি।) অইখানে কাজী মোতাহার হোসেন বলতেছেন ‘সামান্য রদবদলে’ তেমন আপত্তি করতেন না কাজী নজরুল ইসলাম, যেইখানে রবীন্দ্রনাথ একটু এইদিক-সেইদিক হইলে প্রচন্ড মাইন্ড করতেন!
কিন্তু ঘটনা এইটাও না, এ.আর. রহমান তো আর গানটার ‘সামান্য রদবদল’ করেন নাই, রি-ক্রিয়েট করছেন গানটারে; তো, এই জিনিসটা কাজী নজরুল ইসলামের পছন্দ না হইলেও এই রি-ক্রিয়েশনের জায়গাটা উনি বুঝতেন, এবং এ.আর. রহমানের চাইতে তার সুরটাই যে ফার ফার বেটার এইটা বুঝতে পাইরা একটু হাসতেন।
এখন ঘটনা হইতেছে, একদল রবীন্দ্র-পূজারির জায়গায় নজরুল-মুরিদ পাইতেছি আমরা কালচারাল দুনিয়ায়, যারা মনে করেন একজন আর্টিস্টের কাজ হইতেছে ‘পূত পবিত্র’ জিনিস, একচুল নড়চড় করা যাবে না, একটা শব্দ এইদিক-সেইদিক করা যাবে না, রিডিংয়ের বা মিনিংয়ের কোন ‘ব্যতয়’ ঘটানো যাবে না! মানে, অডিয়েন্স হিসাবে আপনার ‘মর্যাদা’ ডিপেন্ড করতেছে যেন একটা সেন্স অফ অরিজিনালিটির উপর! এইটা খালি ইনসেইন একটা ঘটনা না, এই যে অডিয়েন্স হিসাবে ‘মর্যাদা’ দাবি করাটা – এইটা টু সাম এক্সটেন্ড একটা শেইমফুল ঘটনাই।
২.
এই কথা বলার পরেও, এইটা তো বলা-ই লাগবে যে, এ.আর. রহমানের সুরটা শুইনা আমারও হাসি-ই পাইছে। এই কারণে না যে, এইটা ফানি একটা সুর হইছে বা ‘বুলন্দ’ ব্যাপারটার বারোটার বাজায়া দিছেন; এইগুলা তো আছেই; বরং, যেইভাবে উনি গানটারে রিড করছেন সুর করার সময়ে সেইটা আর ভুল থাকে নাই, একটু ফানিও হয়া উঠছে। মানে, দিন কে দিন আর্ট-কালচার একটা পলিটিকাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের লগে রিলিটেড একটা ঘটনা হয়া উঠতেছে; কোন কনটেক্সট থিকা আপনি দেখতেছেন, সেই বেইজটাই আর্টের জায়গাটারে তৈরি কইরা দিতেছে – গ্রেট বানায়া তুলতেছে, বা ফালতু মনে হইতেছে। মানে, একটা পলিটিকাল অরিয়েন্টশন আর্ট-ক্রিয়েশনের লগে সবসময় এফিলিয়েটড ছিল, কিন্তু এখন আরো ক্লোজলি রিলিটেড।** এ.আর. রহমান এই জায়গাটাতে গ্রস একটা মিসটেক করছেন।
কাজী নজরুল ইসলামরে উনি কলোনিয়াল কলকাতার একজন আর্টিস্ট হিসাবে দেখছেন, ইন্ডিয়ার বাংলা প্রদেশের রিজিওনাল একটা প্রডাক্ট হিসাবে। উনি যে বাংলাদেশ আইডেন্টিটির একজন আর্কিটেক্ট – এই জায়গা থিকা দেখতে পারেন নাই। যেই কারণে দেখবেন, ইন্ডিয়ান মিউজিশিয়ানরা নুসরাত ফতেহ আলী খান’রে কপি করতে পারে না বা অনেক পাকিস্তানি লিজেন্ডরেই; এই কারণে না যে কাওয়ালি সিঙ্গারদের গলা অনেক ‘বুলন্দ’ (যেইটা হাহাহিহি করা হিন্দি-সিঙ্গার পারে না কিন্তু অইটা একটা এক্সটার্নাল ঘটনাই); বরং উনাদের কালচারাল ও পলিটিকাল অরিয়েন্টেশনের জায়গাটাই উনারা মিস কইরা যান; যার ফলে খুব বাজে-ধরণের কপি হয়, আর্ট হিসাবে সাসটেইন করতে পারে না। (যেমন ধরেন, জেমসের গান কে.কে.’র দিয়া গাওয়া ফিল্ম-ফেয়ার এওয়ার্ড দিলেও অইটা জেমসের গানই থাকে।)
আর্টিস্টরা, রাইটার’রা হইতেছে আসলে ফিউচার-থিংকার, উনারা উনাদের আর্টের ভিতর দিয়া এমন একটা অডিয়েন্সরে, জনগোষ্ঠীরে প্রজেক্ট করেন যেইটা এখনকার মোমেন্ট নাই-না, বরং তৈরি-হওয়ার ভিতরে আছে; এবং মানুশ-জন যখন আর্টিস্টের, রাইটারের অই ফিলিংসের জায়গাটাতে পৌঁছাইতে পারে তখন আসলে আর্ট-ওয়ার্কটা একটা আইডেন্টিটি হয়া উঠে; যেমন ধরেন, ইকবাল হইতেছেন পাকিস্তান-ধারণার একজন আইকন, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজও। যেই কারণে দেখবেন বাংলাদেশের যারা ‘ইসলামি-কবি’ (ফররুখ আহমেদ, গোলাম মোস্তফা…) উনারা পাকিস্তান আমলে ইকবালেরই মুরিদ ছিলেন, কাজী নজরুল ইসলামরে উনাদের ‘আদর্শ’ হিসাবে নেন নাই; বরং একেকজন ‘নতুন রবীন্দ্রনাথ’ হইতে চাইছেন। যিনি বা যারা একটু-আধটু নিতে পারছেন (যেমন, জসীমউদ্দিন) উনারা নজরুলরে প্রেইজ করতে পারছেন।
আমি বলতে চাইতেছি, আর্টের রিডিং আর্ট-ক্রিয়েশনেরই একটা পার্ট। ভুল-রিডিং দিয়া আপনি ট্রু-আর্ট ক্রিয়েট করতে পারবেন-না না, এইটা এখনকার সময়ে টাফ। আর এ.আর. রহমানের মিউজিকটা এর একটা ভালো উদাহারণ।
৩.
আমার কথাটারে যদি আরেকটু ডিটেইল করি, তাইলে বলবো, এ.আর.রহমান ইন্ডিয়ার বাংলা-প্রদেশের একটা গানরে রি-ক্রিয়েট করছেন; দেখছেন যে এইখানকার মিউজিশিয়ানরা কি করেন – একটু দোতারা বাজান, সুরেলা গান গান… তো, এই জিনিসগুলারে উনি ইন-করপোরেট করছেন উনার মিউজিকে। নজরুলের অন্য অনেক গানের ব্যাপারেই এইটা করলে বেটার একটা জিনিস হইতে পারতো। কিন্তু নজরুল তো বাংলা ফোক-সংয়ের একটা এক্সটেনশন না! আর এই ‘ফোক সং’-এর জায়গাটারেও ইন্ডিয়ান-বাংলার মিক্লা-টোন দিয়া ধরতে পারবেন না আপনি, অইগুলা মোস্টলি সিলঅটি, ভাটিয়ালি, ভাওইয়া… গানের একটা পুওর মেনিফেস্টশন। এখন নকলরে বেইজ করলে তো আর আসল পাওয়া যাবে না। যার ফলে, এ.আর. রহমান আরেকটা ‘নকল সুরের’ কাছে গিয়াই পৌঁছাইছেন।…
আর যে কোন গ্রেট আর্টিস্টের মতোই, নজরুলের নিজের কিছু ক্রিয়েশন আছে। গজল, কাওয়ালি বা কিছু দেশি-গানের সুর উনি নিছেন, কিন্তু উনার ‘অরিজিনালিটি’ হইতেছে বাংলা-রক গানের পাইওনিয়ার হিসাবে; যেইটা ১৯৭১-এর পরে বাংলাদেশের ব্যান্ডের গানে পাইবেন। মানে, সলিল চৌধুরি, ভূপেন হাজারিক বা ফকির আলমগীররা অই জায়গাগুলা এক্সপ্লোর করতে পারেন নাই। অনেক পরে আইসা আজম খান, জেমস, এবং কিছু অল্প-পরিচিত ব্যান্ডরা উনাদের কাছ থিকা সাহস পাইয়া সেইটা পারছে। (রাধারমণ, হাছন রাজা, লালন, আবদুল করিম, রাজ্জাক দেওয়ানদের সাথে রিলেশনের জায়গাটারে কিছুটা কানেক্ট করতে পারছেন। খেয়াল করলেন দেখবেন, সব ব্যান্ডের ক্যাসেটেই একটা-দুইটা কইরা ‘ফোক সং’ থাকতো…) উদাহারণ হিসাবে কাজী নজরুল ইসলামের গানের কয়েকটা রক-ভার্সন দিতেছি।*** আমার ধারণা, কাজী নজরুল ইসলাম বাঁইচা থাকলে, এইরকম রি-ক্রিয়েশন দেখলে খুশি হইতেন, ‘মারহাবা, মারহাবা’ বলতেন! 🙂
তবে সবচে স্যাড ঘটনা হইতেছে, এখন এ.আর.রহমান যে তার ভুল পলিটিকাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা অরিয়েন্টশনের কারণে ফেইলড হইছেন – তা না, বরং একটা ‘ইন্ডিয়ান মিউজিকের’ জায়গা থিকা যে কাজী নজরুল ইসলামের গানরে একোমোডেড করতে চাইতেছে – সেইটা; আর ব্যাপারটা ঠিক স্যাডও না, বরং চিন্তার কথাই একটা। এই জায়গাতে যদি উনি সাউথ-এশিয়ান আইডেন্টিটি বা ওয়ার্ল্ড-মিউজিকের কনটেক্সট থিকা রিড করতে চাইতেন তাইলেও মেবি বেটার একটা ক্রিয়েশন হইতে পারতো।
এমনিতেও রক-মিউজিক এ.আর. রহমানের সবচে উইক-পয়েন্টই, উনার এন্টায়ার মিউজিক-ক্যারিয়ারে।
ব্যাপারটা (এই পলিটিকাল ‘ভুল’টা) খালি এ.আর. রহমানের না, ওয়ার্ল্ড-কর্পোরেটগুলা বাংলাদেশরে একটা ইন্ডিয়ান টেরিটোরি হিসাবেই কন্সিডার করে – নেটফ্লিক্স, এমাজন, ফেইসবুক, টুইটার, কোকা-কোলা, পেপসি, গার্ডিয়ান, নিউজউইক… মোটামুটি সবাই। এবং বাংলাদেশের মার্কেট দখল করার লাইগা ইন্ডিয়ান কালচারাল প্রডাক্টগুলাতে ‘বাংলাদেশি’ জিনিসপত্র আরো আরো ইনক্লুড করতে থাকবে তারা, ফিউচারে। তো, এইখানে তর্ক’টা মোটেই এইটা না যে, জিনিসটা এনাফ ‘বাংলাদেশি’ হইছে কিনা, বরং বাংলাদেশের অডিয়েন্সের কাছে সেইটা রিচ করতে পারতেছে কিনা! খারাপ হোক, ভালো হোক রিচ করতে পারাটা হইতেছে ইনিশিয়ালি সাকসেসর ঘটনা, এরপরে ‘কালচারালি কারেক্ট’ তো কইরাই নেয়া যাবে।
আমার মতে, এইটাই হইতেছে সবচে চিন্তার ঘটনা। যে, বাংলাদেশের কালচারাল-প্রডাক্টগুলা ইন্ডিয়াতেই তৈরি হইতেছে অনেকদিন থিকা (কলকাতা বা মুম্বাই) আর সেইটাই যে হইতে থাকবে – এর একটা কনর্ফামেশনও এইটা। আর এইটা ঠিক ইন্ডিয়ার পলিটিকাল সাকসেস না, মোস্টলি বাংলাদেশের কালচারাল ফেইলওরের ঘটনা একটা। বাংলাদেশের কালচারাল কনটেক্সটে হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, ইংরেজি… নানান ইনফ্লুয়েন্স থাকবেই, কিন্তু সেই জিনিসগুলারে কোন বাংলাদেশি-বেইজ থিকা না দেখতে পারাটাই কোর ঘটনা এইখানে।
এই জায়গাটা এখনো আইডেন্টিফই করতেই আমরা রাজি না, এর এফেক্টটারে ইনটারনাইলজ করতে পারাটা তো আসলে আরো অনেক দূরের ঘটনাই…
…
*“এখানে আরও একটি বিষয় আলোচিত হতে পারে সেটা সঙ্গীতের স্বরলিপি-ঘটিত বিষয়। রবীন্দ্রনাথের অনুমোদিত প্রয় ছাব্বিশ খানা স্বরলিপি এবং মোহিনী সেনগুপ্তাকৃত “রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বরলিপি” যা রবীন্দ্রনাথ অনুমোদন করেছিলেন সে-গুলোর কাঠামো-ভিত্তিক রূপ ছাড়া অন্যরূপে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে দিতে রবীন্দ্রনাথের প্রচণ্ড আপত্তি ছিল। অথচ নজরুলের অনুমতি নিয়ে যে-সব গানের স্বরলিপি তাঁর জীবিতকালে প্রকাশিত হয় উৎকর্ষ সাধন হেতু তার সামান্য রদবদলে তিনি তেমন আপত্তি করতেন না। এটা ভাবতে অবাক লাগে যে রবীন্দ্রনাথ, যিনি পুরনো রীতিকে ভেঙ্গে স্বাধীন রীতির জন্ম দিলেন, তিনিই স্ববিরোধিতা করলেন সঙ্গীতের শিক্ষকদের অভিনবত্ব দানের জন্য তাঁর গান গাইবার স্বাধীনতা দিতে অস্বীকার করে।”
/আমার বন্ধু নজরুল : তাঁর গান, কাজী মোতাহার হোসেন,
**দুই-চাইর বছর আগে এইরকম একটা আলাপ হইছিল যে, একজন রাইটারের পারসোনাল লাইফ, ফেইসবুক এক্টিভিটি দিয়াও তার আর্টরে জাজ করবে মানুশ-জন; আমি তখন অই জিনিসটারে একসেপ্ট করি নাই, বরং আমার কথা যে, এইগুলা সবসময়ই ছিল, থাকবেও; বরং একজন রাইটারের সোশিও-পলিটিকাল আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা তার আর্ট-ক্রিয়েশনের জায়গাটারে এফেক্ট করতো, করে এবং করবেও আসলে; যেই জায়গাটা এতোদিন এতোটা চোখে পড়তো না আমাদের, এখন সেইটা ক্রুশিয়াল একটা জায়গা হিসাবে এমার্জ করতেছে…
***
ঝর্নার মত চঞ্চল: https://www.youtube.com/watch?v=lArX_cnBMlo
চল চল চল: https://www.youtube.com/watch?v=PpXBTZacycw
কান্ডারি হুশিয়ার: https://www.youtube.com/watch?v=AwLUf-xVk8s
শিকল পরা ছল: https://www.youtube.com/watch?v=E7m03NbnXGg
কারার ঐ লৌহকপাট: https://www.youtube.com/watch?v=fUB3OP67lC0
Leave a Reply