ক্রিকেট হইতেছে মিডিয়ার মায়া-বড়ি

ইলিশ মাছের লেজ
ফেইসবুকেই কোথাও এইরকম একটা সেমি-ভাইরাল লেখা দেখছিলাম; গল্প বা জীবন-কাহিনির মাঝামাঝি একটা জিনিস হবে; মানে, এইরকম জিনিস দেখা যায় আমাদের সমাজে, সেইটা নিয়া কাহিনিটা বলছেন নেরেটর; যে, উনি যখন শ্বশুরবাড়িতে বউ হয়া আসলেন তখন উনার শাশুড়ি কইলেন, বৌমা, ইলিশ মাছের লেজটা তো কেউ খায় না, তুমি খায়া নিও; কয়েকবার এইরকম ঘটার পরে দেখা গেলো, শাশুড়ি বলতেছে, আমার বউমা’র ইলিশ মাছের লেজ তো খুব পছন্দ! মানে, জোর কইরা তারে খাইতে বাধ্য করা হইলো, তারপরে বলা হইলো – তাঁর পছন্দ!
এইরকম আরো আছে, ধরেন ছেলে-মেয়েরা বইলা বসলো, আমার মায়ের মাছের চামড়া খুব পছন্দ! মানে, ছোটবেলায় তারা যেহেতু মাছের চামড়া খাইতো না, মায়ের বাধ্য হয়া সেইটা খাওয়া লাগতো, ফালায়া না দিতে চাইলে; তো, সেইটা হয়া উঠলো – পছন্দ বা ফেভারিট ঘটনা!
“অতিথি-পরায়ন”
তো, এইটা যে খালি পারসনের ব্যাপারে ঘটে – তা না, দেশ বা জাতির আইডেন্টিফিকেশনে এইরকম জিনিসের আরো বেশি দরকার পড়ে, বা কাজে দেয়! যেইরকম একটা ধারণা হইতেছে – বাংলাদেশের মানুশ-জন অতিথি-পরায়ণ! এর মানে হইতেছে বাংলাদেশের মানুশ হিসাবে আপনি ‘অতিথি-পরায়ন’ না, বরং আপনারে সেইটা হইতে হবে, বা এটলিস্ট দেখাইতে হবে!
ব্যক্তির ব্যাপারে যেইরকম, বলা হইলো “আপনি তো ভালো-মানুশ”, তার মানে আপনি সো-কল্ড ভালো-মানুশ না, বরং আপনি হইতেছে কন্ট্রোভার্সিয়াল ইস্যুগুলাতে কোন পজিশন নিতে পারেন না, উঁচা গলায় কথা বলতে পারেন না। মানে, মিনিং কখনোই ডিকশনারি মিনিং না, সবসময়ই সিচুয়েশনাল মিনিং।
ফ্রেন্ডস-এ শুরুর দিকেই একটা ঘটনা আছে যে, মনিকা যারে ডেট করে সে কয় যে, লাস্ট ব্রেকাপের পরে দুই বছর ধইরা সে সেক্স করতে পারে না, শুইনা মনিকা তো খুবই ফ্লাটার্ড হয়, পরে দেখে যে এইটা আসলে একটা “লাইন” যেইটা সে মোটামুটি যার লগে ডেট করে তার লগেই ইউজ করে, এবং এইরকম আরো অনেক “লাইন” আসলে আছে ডেটিং-নর্মসে।
তো, জাতি-ধারণার ব্যাপারেও এইরকম। আপনি ইউরোপিয়ান মানেই আপনি ‘শিক্ষিত’; আপনি বাংলাদেশি মানে আপনি ‘অতিথি-পরায়ন’! “পালঙ্ক” (১৯৭৬) সিনেমাতে এইরকমের একটা সিন আছে যে, পুরান হিন্দু-জমিদারের বাড়িতে পূজার ধূতি-শাড়ি গিফট নিয়া তার আগের এক প্রজা আসছে, যে আর তার অধীনে নাই; তখন দুইজনে মিইলা হা-হুতাশ করতেছে পুরান ট্রাডিশন আর নাই! মানে, এইটা যেন জোর-জবরদস্তি ছিল না কোন, কেবলই পুরান ট্রাডিশন!
এইরকম ‘অতিথি-পরায়ন’ও সাম সর্ট অফ জবরদস্তি বা পুরান ট্রাডিশন না, বরং যেহেতু গেরামে কোন পারমানেন্ট হোটেল-রেস্টুরেন্ট ছিল না, এক গেরাম থিকা দূরের কোন গেরামে যাইতে হইলে পথে খাওয়ার জিনিস নিয়া বাড়ি থিকা রওনা হইতে হইতো; বা অনেক দূরের পথ হইলে তো সেইটা সম্ভব হইতো না, এবং রাতে তো কোথাও না কোথাও থাকতে হবে; এই কারণে ‘অবস্থাপন্ন’ গেরস্তের বাড়িতেই থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হইতো; বড় গেরস্তের বাড়িতে একটা ‘বাংলা ঘর’ থাকতো, যেইখানে মুসাফির’রা থাকতে পারতেন, খাওয়া-দাওয়াও করতে পারতেন; একটা কার্টেসি হিসাবে এইটা ছিল, কারণ এইটা ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না, যুথ-বদ্ধ সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যেই এইটা ইন্ট্রিগ্রেটেড ছিল, ঠিক আলাদা কইরা ‘অতিথি-পরায়ন’ হওয়ার ঘটনা এইটা ছিল না।
কিন্তু তাই বইলা এই নেরেটিভ (বাংলাদেশিরা খুব অতিথি-পরায়ন) দিয়া ইনফ্লুয়েন্সড হয়া কেউ নতুন কইরা এই “গুণ” এডাপ্ট করার ট্রাই করেন নাই – তা না, মানে, অতিথি-পরায়ন হইতে পারাটা তো ভালো জিনিসই, জোর কইরা হইলেও। একইরকমভাবে ক্রিকেটে তো এন্টারটেইনমেন্ট আছে, ফুটবলের মতো এতোটা হাইপার জিনিস না হইলেও ইন্টারেস্টিং গেইম তো; যার ফলে বাংলাদেশের মানুশ-জন ক্রিকেট দেখে নাই, বা দেখবে না – ব্যাপারটা এইরকম না; বরং অই জায়গাটাতে পোর্টেট করাটা হইতেছে ঘটনা’টা। আদতে ঘটনা যেইটা না।
স্পোর্টস-ওয়াশ
সব দেশেই মোটামুটি স্পোর্টস নিয়া মাতামাতি আছে। এইটা খালি ইমোশনাল ঘটনা না, ইকনোমিকাল ও পলিটিকাল ঘটনাও। দুনিয়াতে মানি-লন্ডারিংয়ের একটা বড় উপায় হইতেছে স্পোর্টস, যার ফলে আর্ট-ওয়ার্ক, ফিল্মের পাশাপাশি স্পোর্টস দিয়াও মাফিয়া-মানি এক দেশ থিকা আরেক দেশে পাচার হইতে থাকে। বেটিং, জুয়া তো আছেই। পলিটিকালিও এর লং-টার্ম ইমপ্লিকেশনের জায়গাটারে আমরা ইগনোর করার মতো অবস্থাতে আর নাই। এই নিয়া একটা ভিডিও দেখতে পারেন, যদিও সেইটারে পুরাপুরি বিলিভ করাটা ঠিক হবে না, কিন্তু এর যে আরগুমেন্ট সেইটারে খেয়াল করাটা দরকার। (লিংক: https://www.youtube.com/watch?v=hFw-GYAlJHc)
কিন্তু বাংলাদেশের কনটেক্সটে এইটা খালি বিজনেস ও পলিটিক্সের জায়গাটাতে আটকায়া নাই, বরং ক্রিকেট এমন একটা টপিক, যেইটা নিয়া কথা কইতে পারলে অন্য অনেক কিছু নিয়া কথা বলতে হয় না। ঠিক শাক দিয়া মাছ ঢাকার মতো না, যেইটা কিছুদিন আগেও ছিল; ব্যাপারটা এখন এইরকমের ভয়াবহ জায়গাতে পৌঁছাইছে যে, অন্য অনেক কিছু, যেমন বাজারে জিনিসপত্রের দাম, মামলা-হামলা, গুম-খুনের কথা যেহেতু বলা যাইতেছে না, আগুন-টিভি ও দুর্বৃত্ত-পত্রিকার খবরের চাইতে ক্রিকেট নিয়া ‘চিন্তিত’ হওয়াটা বেটার। মানে, মিনিংলেস কিছু নিয়া বিজি থাকতে হবে তো আমাদেরকে! ক্রিকেট হইতেছে সেই সুপার-ফিশিয়াল জিনিসটা এখন বাংলাদেশে।
মানে, আমার তো ফেসবুক একাউন্ট আছে, আমি তো আড্ডা-তে বসছি, কিছু একটা নিয়া কথা তো বলতে হবে আমারে, যেইটা আমারে এখন আর ‘স্মার্ট’ প্রমাণ না করলেও এটলিস্ট কোন বিপদে ফেলবে না! কিন্তু একই ধরণের মিনিংলেস জিনিস যদি আমরা বারবার করতে থাকি, সেইটা আসলে ‘ডাম্ব’ হিসাবে পোর্টেট করতে থাকবে। যেমন চাইলেও খুববেশি ‘অতিথি-পরায়ন’ হইতে পারতেছি না আমরা, মিডিয়া যেহেতু আমাদেরকে ‘ক্রিকেট-পাগল’ ন্যাশন বানাইতে চাইতেছে, সেই জায়গাটাতে পারফর্ম করাটা পসিবল হইতেছে না আর আমাদের! মানে, ধরেন আপনি একটা স্টেইজে উঠছেন, আপনার সামনে মাইক্রোফোন আছে, (একটা ইমাজিনড) সবাই আপনার কথা শুনতেছে, কিছু একটা নিয়া কথা তো বলতে হবে আপনারে – এইরকমের একটা চাপ আছে; তখন ক্রিকেট নিয়া কথা-বলাটা হইতেছে একটা ঘটনা; যেন সবাই বুঝবে, ইন্টারেস্টেড হবে; কিন্তু আসলে আপনি যেইটা করতেছেন, যেইটা আপনি ফিল করতেছেন, সেইটারে এড়াইতে গিয়া এই টপিকটা নিয়া কথা বলতেছেন। এইটা একটা ওয়ে-আউট, এবং বাজে ধরণেরই ওয়ে-আউট।
মায়া-বড়ি’র ঘটনা
বাংলাদেশে বার্থ-কন্ট্রোলের পপুলার জিনিস ছিল এই মায়া-বড়ি, ১৯৮০-দশকে; সরকারিভাবে বার্থ-কন্ট্রোল প্রমোট করার জন্য এই মায়া-বড়ি সাপ্লাই দেয়া হইতো; পরে ফার্মেসিতেও বেচা শুরু হয়। বেটা-মানুশের জন্য রাজা কন্ডমও ছিল, কিন্তু বেটা-মানুশরে ‘শিক্ষিত’ করাটা তো টাফ-ই (মানে, বেটাগিরি তো তত একটা থাকে না তাইলে) 🙂 যার ফলে মায়া-বড়ি পপুলার হইতে পারছিল। তো, মায়া-বড়ি’র মানে এইটা না যে, আপনি জন্ম-নিয়ন্ত্রণ করতেছেন, বরং এইটা একটা কনফার্মেশন যে, আপনি নিয়মিত সেক্স-লাইফে আছেন। এমনকি মাগি-পাড়াগুলাতে মেয়েদেরকে মায়া-বড়ি খাওয়ানো হইতো পেট-বাঁধানো বন্ধ করার জন্য না, বরং এর সাইড-এফেক্ট হিসাবে শরীর ফুইলা যাইতো, রোগা-শরীরে চর্বি-মাংস জমানোর জন্যও ইউজ করা হইতো! 🙁
ক্রিকেটের আলাপ তুইলা সিরিয়াস-ইস্যুগুলারে হাইড করা হইতেছে, নন-ইস্যুরে সামনে নিয়া আসা হইতেছে – এইটা তো একটা ঘটনা, সবাই মোটামুটি বুঝতে পারেন, “কোন বিকল্প নাই” বইলা এর থিকা বাইর হইতে পারতেছেন না, প্যাশন হিসাবে পোর্টেট কইরা যাইতেছেন; কিন্তু একইসাথে এইটা যে, মানুশ হিসাবে আমাদের নন-প্রডাক্টিভ না, বরং সাব-হিউম্যান স্ট্যাটাসে রিডিউস কইরা রাখতেছে – এইটা খেয়াল করার মতো জায়গাটাতে মনেহয় আমরা যাইতে পারতেছি না এতোটা।
আমার কথা এইটা না যে, ক্রিকেট খেলা দেখা যাবে না, বা ক্রিকেট নিয়া কথা বলা যাবে না, বা এইটা নিয়া একসাইটেট হওয়া যাবে না (ম্যাক্স ওয়েলের বেটিং তো ছিল রিমার্কেবল একটা ঘটনা), বরং ওভারঅল এই “ক্রিকেট-উন্মাদনা” বা ক্রেইজটা কি পারপাস সার্ভ করে, কেমনে করে – এইটা দেইখা চোখ বন্ধ কইরা রাখাটা মুশকিলই হওয়ার কথা আমাদের।
Leave a Reply