পলিটিক্যাল পার্টি হিসাবে বিএনপি’র সাথে আওমিলিগের বেসিক ডিফরেন্সের জায়গা কোনটা?

Share

এইরকম একটা কথা-বার্তা বাজারে অনেকদিন থিকাই চালু আছে যে, বিএনপি আর আওমিলিগ তো একইরকমের দল – পরিবারতন্ত্র দিয়া চলে, দলের ভিতরে ডেমোক্রেসি নাই, ইকনোমিক পলিসিতে কোন ডিফরেন্স নাই, পুপলিস্ট, এইরকম অনেককিছুই। (স্পেশালি আওমিলিগের কালচারাল উইংয়ের বাম-বাটপারদের নেরেটিভ এইটা।) কিন্তু একটা ডিফরেন্সের জায়গা ছিল বিএনপি’র, যখন খালেদা জিয়া দলটারে লিড করতেছিলেন। সেইটা হইতেছে, বিএনপি পলিটিক্যাল দল হিসাবে পিপলস পাওয়ারে বিশ্বাস করতো, ক্ষমতার সাথে ষড়যন্ত্র করার চাইতে। কন্সপিরেসি জিনিসটা পলিটিক্যালি আওমিলিগের যতোটা পছন্দের জিনিস, সেইটা বিএনপি’র ছিল না।

একটা স্পেসিফিক ঘটনার কথা তো বলা-ই যায়। সেইটা হইতেছে, ১৯৮৬ সালে এরশাদের আন্ডারে ইলেকশনের ঘটনা। লাস্ট মোমেন্টে আওমিলিগ এরশাদের প্রেসিডেন্সি মাইনা পার্লামেন্ট ইলেকশনে পার্টিসিপেট করছিল, সিপিবি’রে নিয়া। অবৈধভাবে দখল করা ক্ষমতার লগে আঁতাত করছিল। আর এই ইলেকশনের ভিতর দিয়া এরশাদ কিছুদিনের লাইগা হইলেও লেজিটিমিসি ক্লেইম করতে পারছিল। (এইটাই একমাত্র ঘটনা না। পাকিস্তান আমলের পিপলরে বাইপাস করার আরেকটা ঘটনা আছে আওমিলিগের। খেয়াল করলে, আরো কিছু পাওয়া যাবে হয়তো।) যদিও মনে হইতে পারে, এইটা ছিল একটা পলিটিক্যাল স্ট্রাডেজি, কিন্তু আদতে এরশাদের লগে একটা কোলাবরেশনই ছিল অইটা।

খালেদা জিয়া সেইটা করেন নাই। অনেকেই ভাবছিল তখন, বিএনপি বিপদে পইড়া গেল। আওমিলিগ ভালো একটা চাল দিছে! কিন্তু সেইটা হয় নাই। যে স্বৈরাচার, সে তো কোনদিনই ডেমোক্রেসিরে নিতে পারবে না, নেয়ার কোন কারণই নাই। যার ফলে অই পার্লামেন্ট (এমনিতেই প্রি-প্ল্যান্ড ইলেকশন ছিল) দুই বছরের বেশি টিকে নাই। আর আওমিলিগের এই ষড়যন্ত্রের স্বভাবের কারণেই, যখন বাংলাদেশে প্রথম ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশন হইলো ১৯৯১ সালে, মানুশ-জন আওমিলিগরে ভোট দেয় নাই, জিতায় নাই। (যে আপনারে বিশ্বাস করে না, আপনি কি তারে বিশ্বাস করবেন? কেমনে করবেন?)

এই ডিফরেন্সের জায়গাটা মনে রাখাটা দরকার। এই কারণে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের মানুশের কাছে এখনো পপুলার। কারণ উনি ক্রিটিক্যাল মোমেন্টে পিপলের উপরে ভরসা রাখছেন। খুব কম পলিটিশিয়ানই এই বিশ্বাস রাখতে পারছেন। কিন্তু মুশকিল হইলো, বিএনপি এই জায়গাতে থাকতে পারে নাই। দুইটা জায়গাতে ভাগ হয়া গেছে। বিএনপি’র ক্রিটিকরা বিএনপিরে যেই দোষগুলা দিছে, সেইগুলারেই বেইজ হিসাবে নিয়া আঁকড়াইয়া ধরছে, নাইলে অপোজ করার চেষ্টা করছে।

বিএনপি’র এগেনেস্টে সবচে বড় ক্রিটিক’টা তো হইতেছে যে, বিএনপি হইতেছে মিলিটারি’র দল! জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্ট থিকা এই দল বানাইছে এবং মিলিটারির একটা বড় অংশের সবসময় বিএনপির প্রতি সফট কর্ণার আছে। এখন জন্ম যেমনই হোক, বা যেইভাবেই হোক, একজন মানুশ বা একটা পলিটিক্যাল দলরে তার কাজকামের ভিতর দিয়াই আইডেন্টিফাই করা বা চিনতে পারা দরকার আমাদের। বিএনপি শুরু থিকাই ছিল ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ সার্পোটার। অন্য অনেক দল থাকতে হবে, এইটা তাদের কাজকামের মধ্যে সবসময় ছিল। যেইটা আওমিলিগের মধ্যে নাই, ছিলও না। যখনই আওমিলিগ ক্ষমতায় গেছে অন্যসব পলিটিক্যাল দলরে বাদ দিয়া একটা দল বানাইছে, না পারলে বি-টিম বানায়া নিছে।

তো, বিএনপি’র একটা অংশ এই ‘মিলিটারির দল’ ক্রিটিকে খুবই বিশ্বাস করে এবং ধারণা করে যে, মিলিটারি আইসা তাদেরকে ক্ষমতায় বসায়া দিবে। ২০০৭ সালের ১/১১’র পরে সেই আশা নাই। আর এইটা কখনোই বিএনপির স্ট্রেংথ ছিল না আসলে। অই ঘটনা নিয়া এখনো নিশ্চিতভাবে কিছু বলা তো মুশকিলই, কিন্তু আমার একটা অনুমান হইতেছে যে, খালেদা জিয়া তখনো পিপলের উপরেই বিশ্বাস রাখতে চাইছেন, মিলিটারি-আমলাদের বিশ্বাস করেন নাই। কিন্তু বিএনপির অনেকেই যে এই বিশ্বাস নিয়া আছেন (বা ছিলেন), সেইটা বিএনপির সবচে উইক পয়েন্ট।

এই জায়গা থিকাই নিজেরা কন্সপিরেসির ট্রাই করছে ক্ষমতায় থাকার সময়। কিন্তু বিএনপির রাজনীতি যতটুকই ছিল, ছিল আসলে এই কন্সপিরেসির এগেনেস্টেই। যখন অই জায়গাতে গেছে, পিপলের কাছ থিকা দূরে সইরা আসছে আরো। ইন ফ্যাক্ট, খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপির অন্য সব লিডারদের কাছে এই জিনিসটা কখনো স্পষ্ট ছিল কিনা, এইটা নিয়াও আমি কিছুটা ডাউটফুল।

আরেকটা টেনডেন্সি হইতেছে, যেহেতু ‘ক্যান্টমেন্টের দল’ বলা হয়, এর এগেনেস্টে বিএনপি দেখাইতে চায় যে, মিলিটারি না, বরং বুদ্ধিজীবী-আমলারাও তো আছে তাদের দলে! জনগণরে বাদ দিয়া যারা “জনগণরে রিপ্রেজেন্ট” করেন বইলা দাবি করেন – মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কালচারাল ও এলিট মিডল-ক্লাস, এইরকম যারা আছে, সেই বাটপারদের লগে তাল মিলানোর একটা চেষ্টার ভিতর ছিলই সবসময়, কিন্তু এইটা টেনডেন্সি হিসাবে এখন স্পষ্ট হইতে পারতেছে। যেইটা আসলে আওমিলিগেরই পলিটিক্স। পিপলরে বাদ দিয়া যেইসব উপায়ের ভিতর দিয়া পিপলরে কন্ট্রোলে রাখা যায়, তাদেরকে ম্যানিপুলেট করা যায় সেই জায়গাগুলারে প্রায়োরিটি দেয়া। এইটা পলিটিক্স না, এইটাই হইতেছে ষড়যন্ত্রের জায়গাটা। পলিটিক্যাল দল হিসাবে যদি কেউ পিপলের কাছে নিজেরা রিচ করতে না পারে, সেইটা অন্য কোন থার্ড-পার্টির ভিতর দিয়া সেইটা করা সম্ভব না।

বাংলাদেশে এখন একটা বুঝ আছে যে, যেন ষড়যন্ত্র করতে পারটাই হইতেছে পলিটিকস! অথচ পলিটিকস বলতে যদি এখনো কিছু থাকে, সেইটা হইতেছে যে কোন ষড়যন্ত্রের এগেনেস্টে পিপলের পার্টিসিপেশনের জায়গাগুলারে তৈরি করা। একটা সিস্টেম বানায়া সেইটারেই পিপলস রিপ্রেজেন্টশন দাবি করা না, বরং কোন সিস্টেম যখন কন্সপিরেসিটারেই নিয়ম বানায়া ফেলে সেই সিস্টেমটারে বাতিল করার ঘটনাটা।

আনফরচুনেটলি, বিএনপি এই সিস্টেমের বাইরে যাইতে পারে নাই। খালেদা জিয়ার যেই বিএনপি ছিল, এখনকার বিএনপিতে সেই মিনিমাম জায়গাটা নিয়া স্ট্রাগল করতেছে। এই মিসিং জিনিসটা কারোরই ফিল না করতে পারার কথা না মনেহয়। বিএনপির রাজনৈতিকভাবে যদি কোন ফেইলওর থাকে, আমি মনে করি, স্পেসিফিক্যালি সেইটা এই জায়গাটায়।

/২০২১

[গত দুই বছরে বিএনপি এই জায়গাটা অনেকটাই ওভারকাম করতে পারতেছে মনেহয়।]

ইমরুল হাসান

কবি, ক্রিটিক, ফিকশন-রাইটার, ট্রান্সলেটর। জন্ম ১৯৭৫ সালে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

  • September 1, 2023