অবিচুয়ারি: মোহাম্মদ রফিক

Share

বাংলাদেশের খুব বেশি ‘বড় কবিদের’ সাথে আমার দেখা-সাক্ষাত হয় নাই; যেমন ধরেন, আল-মাহমুদ, শামসুর রাহমান… উনারা তো তখনো বাঁইচা ছিলেন যখন আমি ঢাকা শহরে আসি, থাকতে শুরু করি, কিন্তু উনাদের দেখা হওয়ার মতো জায়গাতে যাওয়া হয় নাই আমার। তো, মোহাম্মদ রফিকের সাথে আমার দেখা হইছিল। উনিও ‘বড় কবি’দের কাতারে ছিলেন একটা সময়। মানে, তখনকার সময়ে ‘বড় কবি’ একটা টার্ম হিসাবে কয়েন করা হইতো, যারা আসলে কম-বেশি একটা গ্রুপের লোকই ছিলেন। পত্রিকায় কবিতা ছাপাইলে যাদের লেখা শুরুতে থাকতো বা রাখা লাগতো, এইরকম।

তো, উনার সাথে দেখা হইছিল জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে, উনার টিচার্স কোয়ার্টারের বাসায়। আমরা (আমিনুল বারী শুভ্র আর আমি) তখন স্কুল পাশ কইরা কলেজে উঠছি। আমি ঢাকা কলেজের সাউথ হলে থাকি। শুভ্র ঢাকায় আসার পরে আমরা সুমন ভাইয়ের (সুমন রহমান) কাছে গেলাম একদিন জাহাঙ্গীরনগরের বাসে কইরা, সালাম-বরকত হলে। তখন আমরা কবিতার দুনিয়ায় ঢুকে গেছি।

দুই-তিন দিন থাকলাম। দুপুর-বিকাল-রাতে অনেক হাঁটলাম। অনেক উইড ইনহেল করলাম। পিয়াল ভাই, রোকন ভাই, চঞ্চল ভাইয়ের গান শুনলাম। খায়ের ভাইয়ের পিঞ্চিং এনজয় করলাম। কণা-আপা’র সাথে দেখা হইলো। এইরকম ঘটনার মধ্যে দিয়া একদিন দুপুরে মোহাম্মদ রফিকের কোয়ার্টারেও গেলাম।

বিশাল গোঁফ ছিল উনার। মিটিমিটি হাসতেছিলেন আমাদেরকে দেইখা। কফিল ভাইয়ের কথা জিগাইলেন। কফিল ভাই তখন জাহাঙ্গীরনগরে ছিলেন না। সুমন ভাই’রে উনি হাসতে হাসতে বললেন, তুমি তো বাচ্চা-ছেলেদেরকে নষ্ট করে দিচ্ছো! আমরাও হাইসা দিলাম। বললাম, না, না, আমরা তো কলেজে পড়ি!

তো, মোহাম্মদ রফিক পিয়াল ভাইরে (মাহবুব পিয়াল) পছন্দ করতেন বেশি, আমরা টের পাইলাম। পরেও খেয়াল করছি পিয়াল ভাই-ই মোহাম্মদ রফিকের কবিতার জায়গাটারে এক্সপ্লোর করতে বেশি ইন্টারেস্টেড ছিলেন। সুমন ভাই উনার কবিসঙ্গ’টারেই বেশি নিছেন, কবিতার জায়গাটারে এতোটা না।

উনার বাসা থিকা বাইর হয়া আমরা শুনলাম যে, জাহাঙ্গীরনগরের সাহিত্য-সমাজে দুইটা গ্রুপ আছে; তবে সবাই মোটামুটি সেলিম-আল-দীনের গ্রুপেরই লোকজন; মোহাম্মদ রফিকের দলবল তেমন নাই, কয়েকজন পারসোনাল এডমায়ারার-ই আছেন। উনিও নিজের প্রেম-ট্রেম নিয়াই ব্যস্ত থাকেন বেশিরভাগ সময়। উনার ছেলেও তখন জাহাঙ্গীরনগরের টিচার ছিলেন।

মোহাম্মদ রফিকের কবিতা পরে পড়ছি আমি। ‘কপিলা’ নামে একটা দীর্ঘ-কবিতা ছিল উনার। উনি হিস্ট্রিরে মিথিকাল এক্সপ্লোরেশনের জায়গা হিসাবে দেখতে চাইছেন বইলা আমার মনে হইছে। কবিতা দিয়া অই জায়গাটারে কন্সট্রাক্ট করতে চাইছেন। ব্যাপারটা কিছুটা একসেপশনাল ঘটনা হইলেও কবিতার জায়গাতে একসাইটিং কোন জিনিস হইতে পারে নাই।

সেইটা যা-ই হোক, কবিতা লেইখা আর কয়জন কবি হইতে পারছে বাংলাদেশে! একটা সামাজিক সার্কেলের মেম্বার হওয়ার ভিতর দিয়া কবি হওয়ার ঘটনাটা বেশি ঘটে। অই সার্কেলে একটা সময়ে প্রমিনেন্ট ফিগার বা বড়-কবি হইলেও অনেকদিন আগেই উনি ব্লার/ঝাপসা একটা ফিগার হয়া উঠছিলেন। তার অনেকদিন পরে গতকালকে উনি মারা গেলেন।

আর কবি’র মারা যাওয়া তো তার কবিতার মারা যাওয়া না; অনেক সময় অনেক আগেই কবিতা মারা যায়, অনেক সময় তারও অনেকদিন পর; আর সবসময় বাঁইচা উঠার একটা সম্ভাবনার মধ্যে তো থাকেই।

ইমরুল হাসান

কবি, ক্রিটিক, ফিকশন-রাইটার, ট্রান্সলেটর। জন্ম ১৯৭৫ সালে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

  • August 7, 2023