দুর্ভিক্ষের কথা – ইমরুল হাসান

Share

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ-রে যে এখনো ভয়াবহ বইলা ভাবতে পারি আমরা, এর একটা কারণ হইতেছে জয়নুল আবেদীনের স্কেচগুলা। এই ছবি বাদ দিলে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের “অশনি সংকেত” নভেলে কিছুটা আছে। এর বাইরে এই ঘটনার তেমন কোন ডকুমেন্টশন নাই সাহিত্যে, আর্টে।

আব্বাসউদ্দিন আহমদ উনার অটোবায়োগ্রাফিতে বলতেছেন কলকাতা ধীরে ধীরে কালো হয়া যাইতেছিল, গেরামের ময়লা-রংয়ের মানুশ দিয়া ভইরা যাইতেছিল। কিছুদিন ছিল। তারপরে পুলিশ একদিন তাদেরকে ধইরা নিয়া শহরের বাইরে ফেলে দিয়া আসলো। মানে, এই অবস্থাটা বেশিদিন ছিল না। (আর যাদের কথা-ই পাইবেন, দেখবেন যে, একটু দূর থিকাই উনারা দেখতেছেন। মানে, উনারা, মধ্যবিত্ত শিল্পী-সাহিত্যিকরা অই ক্লাসের লোকজন ছিলেন না, যাদেরকে দুর্ভিক্ষের কারণে না-খায়া থাকতে হইছিল।…) জয়নুল আবেদীন মেবি তখনই ছবিগুলা আঁকছিলেন।

“একটা কথা ইদানীং কানে এল। কালোবাজারে জিনিষ কিনতে গিয়ে দেখি এটা নাই। ওটা নাই, যেটা আছে সেটাও অগ্নিমূল্য। দোকানদার বলে, “মশাই নিতে চাইলে এখুনি কিনে ফেলুন, কাল আর পাবেন না।” ব্যাফল্ওয়ালের আশে-পাশে কঙ্কালসার নরনারী এখানে ওখানে নজরে পড়তে লাগল। তারপর ঝাঁকে ঝাঁকে। শুনতে পেলাম দেশে ধান চাউল নেই। মহাদুর্ভিক্ষ। রাতে “’ফেন দাও ফেন দাও” বলে সেইসব কঙ্কালসার নরনারীর কী চীৎকার! পেটে আর ভাত যায় না। একবেলা খাই আর একবেলার ভাত পথের কাঙালীকে দিই। চোখের সামনে ইতস্ততঃ না-খেয়ে-খেয়ে-শুকিয়ে-মরা লাশ নজরে পড়তে লাগল। তারপর এ দৃশ্য দেখতে পেলাম যত্রতত্র। পুলিশের তৎপরতা বাড়ল। গাড়ীভর্তি করে কঙ্কালগুলোকে শহর থেকে কোথায় চালান দেওয়া শুরু করলে – কলকাতায় আর ভিখারী বা দুর্ভিক্ষ-প্রপীড়িত কঙ্কালসার মূর্তি চোখে পড়ে না।”

/আমার শিল্পী-জীবনের কথা, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ১৯৫৯

সেই তুলনায় ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা যে আমরা মনে করতে পারি না, এর একটা কারণ হইতেছে, এইটা নিয়া তেমন একটা আর্ট বা লিটারেচার নাই। এক আছে আজম খানের “বাংলাদেশ” গানটা। উনি বলতেছিলেন, কমলাপুর রেলস্টেশন থিকা নটরডেম কলেজ পর্যন্ত কালা কালা কাদা হয়া গেছিল। তবে দুর্ভিক্ষের কিছু নিউজ এখনো খুঁজলে পাওয়া যাবে, নিউইয়র্ক টাইমসের একটা নিউজ ছিল মেবি, ডিটেইল। আওমিলিগের অফিসিয়াল ইউটিউব সাইটেও একটা ইন্টারভিউ আছে শেখ মুজিবুর রহমানের।  যার ফলে, দুর্ভিক্ষ হয় নাই – এই ক্লেইম করাটা মুশকিলের হয়। স্বীকার করার মতো কিছু জায়গা আছে, ব্যাখ্যা যেইরকমই হোক।

 

 

“এই গানটা, আমি যুদ্ধের পরে যখন আমাদের এইখানে খুব সময়টা খারাপ যাচ্ছিল, মানে কী বলব আর কি—দুর্ভিক্ষ। খালাম্মারা দুধ আনতে যাইতাছে কাদা পাড়ায়া, চেয়ারম্যান অফিসে, দুধ পায় না ফেডো। এই রাস্তা স্টেশন থাইকা আরামবাগ, নটরডেম পর্যন্ত, কালো হয়া গেছে, গ্রামের মানুষ ঢাকা আইসা গেছে। ঢাকা আসলে বোধহয় আমরা কিছু বাঁচতে পারব। এরকম দুর্ভিক্ষ। কালো ছায়া, মানুষ মইরা যাইতাছে, লাশ দাফন করার মতো মানুষ নাই। মা বাচ্চারে ফালাই থুয়া ভাগতাছে। আমি প্রোগ্রাম ট্রোগ্রাম কইরা আসতাম, বড় বড় বাবরি দাড়ি, বুঝছেন, একটু ভাব আলাদা, তখন আইসা দেখতাম, ছোট ছোট বাচ্চারা মামা মামা করত, আমিও পয়সাগুলি সব বিলায়া দিতাম। তখন আমার কইলজা ফাইটা গান বাইর হইলো, রেললাইনের ওই বস্তিতে জন্মেছিল একটি ছেলে, মা তার কাঁদে, ছেলেটি মরে গেছে। এইভাবে গানগুলি তৈরি হইছে আমার আর কি।”

/আজম খান, ২০১১

 

এখন গত এক বছর ধইরা বাংলাদেশে যে “নিরব” দুর্ভিক্ষ চলতেছে, সেইটা দুর্ভিক্ষ মনে হয় না, এরও একটা বড় কারণ হইতেছে আর্ট-কালচারে ব্যাপারটা তো নাই-ই, নিউজও নাই তেমন। “আমি না খায়া আছি” – এই কথা মানুশ-জন তো পত্রিকা-অফিসে গিয়া, সাংবাদিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়া বইলা আসবে না। কিন্তু আশেপাশের “লো-ক্লাসের” লোকজনের দিকে তাকাইলে কিছুটা হইলেও খেয়াল করতে পারার কথা আমাদের যে, মানুশ-জন সাফার করতেছে, কুলায়া উঠতে পারতেছে না।

মানে, এইটা একটা ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের ঘটনা না যে, বাংলাদেশে কি দুর্ভিক্ষ চলতেছে নাকি চলতেছে না? এইটা সত্যি-কথা নাকি মিথ্যা-কথা? বরং আমি বলতে চাইতেছি, আর্ট-কালচার দিয়া, নিউজ-টিউজ বেইজ কইরা “সমাজের সত্য” আবিষ্কার করতে চাওয়ার যেই রেফারেন্স-সিস্টেমটা সেইটা ভুয়া না হইলেও এইটারে রিয়ালিটি কনজামশনের একমাত্র রাস্তা হিসাবে ধইরা নিলে অনেক কিছু দেখতে পাবো না আসলে আমরা।

ইমরুল হাসান

কবি, ক্রিটিক, ফিকশন-রাইটার, ট্রান্সলেটর। জন্ম ১৯৭৫ সালে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

  • March 16, 2023