‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ যতটা সুদৃশ্য অতটা সুশ্রাব্য না – চিংখৈ অঙোম

Share

‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ যতটা সুদৃশ্য অতটা সুশ্রাব্য না।

রূপক আর প্রতীকে ভরা। তথ্যে ঠাসা। চরিত্রগুলি এক একজন জীবন্ত উইকিপিডিয়া যেনো। কিছু জিজ্ঞেস করলেই সিরি-এলেক্সার মতো অনর্গল বলাবলি শুরু কইরা দেয় ভাটির জীবন সম্পর্কে যে যে যা যা কিছু জানে।

চরিত্রগুলি কথা একটু কম বললেই বরং নিরব ছবিগুলি অনেক বেশি বাঙ্ময় হয়া উঠতে পারত।

কারণ ছবিগুলি সুন্দর। ঘোলা জল, পাকা ধান, মাটি ও খড়, এইসবের বাদামি একটা প্যালেট। আরেকটা, মলিন ধূসর জল ও জমিন জুইড়া হাওড়ের বুকে বুকে জাইগা থাকা হঠাৎ হঠাৎ সবুজ কিংবা পাতাবিহীন গাছ। আকাশের মুখে কালো মেঘের কালি লেপটায়া যাওয়া কিংবা সাদা আকাশের জমিনে জাইগা থাকা সবুজ ধানের পাড়, এইসব দৃশ্যাবলী মহাকাব্যিক দ্যোতনায় ধরতে পারছেন চিত্রগ্রাহক মাজহারুল রাজু। দেশীয় নানান পুরস্কারও জুটছে তার কপালে।

আমরা এই নন্দনে অভ্যস্ত। এইটা আমাদেরই রুচি। হাওরের রোমান্টিক আর গ্ল্যামারাইজড যে দৃশ্যাবলি ভোগ কইরা আমাদের ট্যুরিস্ট মনন অলরেডি অভ্যস্ত, সেইটাই আবার সিনেমার বড় পর্দায় দেখা জাস্ট।

এর বাইরে, ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ একটা এথনোগ্রাফিক সিনেমা। হাওরের জীবনের সবকিছু দেখায়া ফেলার লোভ সংবরণ করা যায় নাই তাই। পণাতীর্থ/বারণী পূজা, ধামাইল, তেলসিন্ধু পূজা, যা আছে সব ভিজুয়াল সালাদ হিসেবে পরিবেশন করা হইছে।

তা দেখানো দোষের কিছু না। তবে তথ্যচিত্র হিসেবে অনাড়ম্বর কইরা দেখাইলেই ভালো হইতো। কিন্তু এই জীবন ও যাপন এবং তা সংলগ্ন নানাবিধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, আচার ও রীতি, ফিকশনের মুখোশে বা অযুহাতে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে অভিনয় কইরা গুঁইজা দিয়া পরিবেশন করাটারে কটু লাগল। বাইরের চোখে যেই বিষ্ময়কর ব্যাপার হিসেবে ধরা পরছে এইগুলারে, সেইটারেই ধরতে এবং ধইরা সেইটা দেখাইতেও চাইছেন পরিচালক। হাওরের জীবন যাপনে যা কিছু দেখছেন জানছেন তিনি, কিছুই বাদ দিতে চান নাই মনে হইছে ছবি দেইখা।

ডকুমেন্টারি ও ফিকশনের সীমানা বিলীন কইরা দেয়ার চেষ্টাটা যে অতো সোজা না সেইটাও উপলব্ধি করলাম।

যেহেতু এই দুইয়ের মাঝখানের আইল ধইরা হাঁইটা যাওয়ার চেষ্টা করছেন নির্মাতা, কাহিনিটারে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করাটা জরুরি। কিন্তু যত্নের ছাপ কম ছিল অভিনয় ও সংলাপে। আঞ্চলিক ভাষার পিছনে যথেষ্ট রিসার্চ ও সময় দেয়া হয় নাই মনে হইছে যতটা না হইছে আঞ্চলিক রিচুয়াল ইত্যাদির খোঁজখবর জোগাড়ে। যদি ইচ্ছাকৃত হয়ে থাকে ব্যাপারটা, মানে যাতে নন সুনামগঞ্জীরা বুঝতে পারে তাই প্রমিতর ফাঁকে ফাঁকে এক দুইটা সিলেটি/সুনামগঞ্জী ওয়ার্ড, ফাইন, ওইটার কেইস আলাদা। আর, অযত্নে অবহেলায় হয়ে থাকলে আলাদা। দুইটাই দোষের। অবহেলা, অসম্মান ও অবজ্ঞার। আমি নিজে সিলেটি হওয়ায় এবং সিলেটি ভাষা পারার কারণে মেবি অস্বস্তি লাগলো সিনেমাটা দেখতে। তেমন না যারা, তাদের কাছে হয়ত দারুণ ব্যপার মনে হইছে সিলেটি ভাষার দারুণ প্রয়োগ হইছে ভাইবা। কিন্তু ডকু, ফিকশন, ডকুফিকশন, যে বস্তুই হোক, এই ব্যাপারটায় যত্ন জরুরি।

নিজেদের গল্প নিজেরা না বইলা অন্য কেউ বইলা দিলে এমনই হয় অবশ্য।

যাই হোক।

তো, সংগ্রাম ও প্রতিরোধের যা কিছু ভেরি ভারি জার্গন, কিংবা আক্রান্ত পরাক্রান্ত হওয়ার যেইসকল ক্ষত, সেগুলি আমাদের অভ্যস্ত রুচির নন্দনে ধারণ করা চোখে আরাম দেয়া চিত্রায়নের দৃশ্যাবলির মলমে সাইরা যায় আসলে। অস্বস্তি কোথাও সৃষ্টি হয় না। বরং দেখতে ভালোই লাগে।

চিত্রনাট্যের ব্যাপারে বললে, গল্পের উল্লম্ফন অনেক। প্লট পয়েন্টগুলি আগে থেকে সাজায়া রাখা যেনো। ডটগুলি কানেক্ট করা হইছে জোর কইরা। ফলে সেলাইগুলি মসৃণ হয় নাই। আরোপিত এবং চোখে লাগে।

এবং খুব দ্রুত ঘইটা যায় ঘটনাগুলি। দুম কইরা বৃষ্টি নামে তো বন্যা হয়া যায়। দুম কইরা মইরা যায় ইত্যাদি। তা যায়। কিন্তু যেভাবে বিল্ডআপ হয়, ঘটনাগুলি ঘইটা যাওয়ার পরে আর কোনো রেশ ধইরা রাখার জায়গা থাকে না, ফলে রেশ থাকেও না, ফলে ঘটনাগুলি তেমন দাগ ফেলে না। ঘটনার এই ঘনঘটা পরিমিতিবোধের অভাব এবং চিত্রনাট্যের দুর্বলতা; হাওরের জীবন এমন ঘটনাবহুল ও নাটকীয় — এইসব যুক্তি কনভিন্সিং না।

এর কারণ মূলত বিশাল ক্যানভাস বাইছা নেয়া এবং অনেক কিছু নিয়া ডিল করা। সেটা করা যায় না তা না। কিন্তু সেগুলি নিয়া উৎরায়া যাওয়ার মতো বুনন হয় নাই আর কি। ঝুইলা গেছে। জোড়া লাগে নাই। ইত্যাদি। ক্যানভাস আরেকটু ছোট কইরা এবং কম জিনিস নিয়া আঁকা যাইতো হয়তো।

সিনেমাটা অতটা সুশ্রাব্য না বলছি কারণ শব্দ আর সংগীত কানে লাগে। অনেক বেশি আর ব্যস্ত সারাক্ষণ। মাঝে মাঝে খুবই কোলাহলপূর্ণ। নিরবতা প্রায় নাই ছবিতে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার ফুরসতগুলিতেও না।

সুকান্ত মজুমদারের শব্দ গ্রহণ ও পরিকল্পনা সাধারণত ভালো। একই রকম জলজ যাপন নিয়া মণিপুরের হাওবম পবন কুমারের ছবি ‘লোক্তাক লাইরেম্বী’তে সাউন্ড নিয়া তার কেরামতি ভালো লাগছিলো। সংগীত ও (অলমোস্ট) সংলাপবিহীন সিনেমা ছিলো সেটা। কেবল শব্দ দিয়াই অনেকটা গল্প বইলা গেছেন সুকান্ত। কিন্তু এই ছবিতে সেই সুযোগ পান নাই ভদ্রলোক। কারণ একটানা সংগীত বাজায়া গেছেন সাত্যকী ব্যানার্জী ও তার দল। বেহালা, সারেঙ্গী, ঢাক, বাদ যায় নাই একটা শিশুও। সংগীতে পরিমিতিবোধের অভাব পুরোটা জুইড়া। বিয়ের ধামাইল গান ঠিক আছে। আবহ সংগীতের কোলাহল নিয়া বললাম।

এই ছবি নিয়া বাংলার বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রশংসা আর উচ্ছ্বাস দেইখা আগ্রহ পাইছিলাম। সিনেমাটা কেমন তা যতটা না বুঝতে, তারচেয়ে বেশি তাদের সিনেমা রুচি সম্পর্কে ধারণা নিতে। তা পাইলাম।

এও বুঝলাম, মূলত ভিজুয়াল মাধ্যম হিসেবেই সিনেমারে ধরলেও — কেউ কেউ এক চামচ বাড়ায়া অডিও ভিজুয়াল মাধ্যমও বইলা থাকেন — সিনেমা কেবল শ্রুতি-দৃশ্য এগুলি দিয়াই হয় না। সাবজেক্ট হিসেবে সাবঅল্টার্নদের বাইছা নিয়া কিংবা যথাসম্ভব জীবনঘনিষ্ঠ আর সংবেদনশীল থাকার চেষ্টা দিয়াও হয় না।

আরেকটা কী জানি কী লাগে।

চিংখৈ অঙোম

সিলেটবাসী। মণিপুরিভাষী। কবিতাকাহিনি-গান-ছবি-মুভি লিখি, গাই, আঁকি ও বানাই। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: পেবেতকী পেনা (২০১৫)।

  • February 13, 2023