কোন মতামতই “শাদা” না, যে কোন ন্যারেটিভের পিছনে বিভিন্ন অভিসন্ধি বা মতাদর্শ কাজ করে – তাসনিম রিফাত

Share

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই লেখাটা কয়েকদিন ধরে টাইমলাইনে ঘুরতেছে কয়েকজনের মারফতে। কিছু লোক এটাকে কেন্দ্র করে আলাপ দিতেছে বিভিন্নভাবে। পুরা লেখাটার ন্যারেটিভ, যেটাকে সংক্ষেপে ‘রেইস’ (Race)- ধারনার সাথে যুক্ত করা যায়। রেইস নিয়ে বিভিন্ন সময় নৃবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন কাজ করছেন। যদিও এখনো এইসব ব্যাপার নিয়ে অনেক অদ্ভূত যুক্তি শুনতে হয়।

যাই হোক, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেই দিছেন, ব্যাপারটা উনি বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে বলছেন না, শাদা চোখের পর্যবেক্ষণের উপর বলতেছেন। কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক যদি শাদা চোখের পর্যবেক্ষণের উপর দাঁড়িয়ে এইধরনের মন্তব্য করেন, সেটা অনেক মানুষকে ভুলভাবে প্রভাবিত করতে পারে। আর আসলে, কোন মতামতই ‘শাদা’ না, যেকোনো ন্যারেটিভের পেছনেই তো বিভিন্ন অভিসন্ধি বা মতাদর্শ কাজ করে।

যাই হোক, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এখানে মোগল, পাঠান, তুর্কি রক্তের কথা এমনভাবে বলতেছে যেনবা এরা স্বতন্ত্র রেইস, এবং প্রত্যেকটা রেইসেরই আলাদা জৈবিক,সামাজিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু আমরা যদি নৃবিজ্ঞানের জায়গা থেকে রেইসের ধারনাগুলো একটু দেখি, তাহলে বলা যায় দুনিয়াতে বিশুদ্ধ রেইস বলতে আসলে কিছু নাই। যেকোনো রেইসই সংকরের ফলাফল। উদ্ভবের শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে এতো বেশি যোগাযোগ ঘটছে, এতো মাইগ্রেশন হইছে যে, সেখানে শুদ্ধ জাতি/বর্ণ/রেইস বলতে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। ফলে, যেকোনো গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যেই নানা বৈশিষ্ট্যের সমাহার ঘটছে।

আর দ্বিতীয়ত, একই প্রজাতির দুইটা প্রাণীর জৈবিক বৈশিষ্ট্যে সচরাচর এতো বেশি পার্থক্য ঘটে না যে দুইটা প্রাণীকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তেমনি, মানব প্রজাতির মধ্যে একাধিক গোষ্ঠীর বা তথাকথিত বর্ণের পার্থক্য এতো বেশিও হয়ে যায় নাই যে এদেরকে আলাদা জৈবিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের বলা যায় মোটাদাগে। এই পার্থক্যগুলো আবার বেশিরভাগক্ষেত্রে পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক আর পরিস্থিতিসাপেক্ষ। যেমন, রেইসের ক্ষেত্রে গায়ের রঙ একটা গুরত্বপূর্ণ মার্কার হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু দেখা যায়, আফ্রিকার এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলের দিকে একটা রেখা টানলে মানুষের গায়ের রঙ ক্রমশ উজ্জ্বল হইতে থাকে। এই উজ্জ্বলতার মূল কারণ হলো ‘গাছ’। যেখানে গাছ বেশি, সেখানে সূর্যের আলো কম তীব্রভাবে পড়ে, সেটাই প্রভাব ফেলে গায়ের রঙ-এ।

আর যখন আমরা একাধিক জাতির অথবা রেইসের ব্রিডিংয়ের কথা বলি, তখন আমরা ধরে নেই যে এর মাধ্যমে দুইটা জাতির গুণগুলার সংমিশ্রন হবে। যেমন ‘শক্তিশালী পাঠান’র সাথে দূর্বল ‘বাঙ্গালি’র বিয়ে হইলে শক্ত সামর্থ্য বাঙ্গালি’র জন্ম হইতে পারে। কিন্তু এই ধারণাটায়ও ঝামেলা আছে। নৃবিজ্ঞানী বোয়াস, তার একটা লেখায় যুক্তি দিছিলেন যে, যেকোনো গোষ্ঠীর নিজের মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন গুণের আদান-প্রদান ঘটে। যেমন, সব বাঙ্গালি তো একরকম না। একটা লম্বা-চওড়া বাঙ্গালির সাথে বিয়ে হইতে পারে একটা খাটো বাঙ্গালির৷এখানেও কিন্তু একটা ভিন্ন জৈবিক বৈশিষ্ট্যের আদান-প্রদান ঘটলো। যেকোনো গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমাগত এইটা হইতেই থাকে৷

যাই হোক, এইযে ‘বাঙ্গালি’ মানেই দূর্বল, পরিশ্রম করে না, ভাবালুতা দেখায় সবখানে, এই সবকিছুর উত্তর তিনটা পয়েন্টে বলি।

১) বাঙ্গালি বলে কোন বিশুদ্ধ জাতি নাই, অনেক জাতির মিশ্রনেই বাঙ্গালি হইছে, দুনিয়ার সব জাতিও তাই। আমেরিকার পুরা জাতিই বিভিন্ন গোষ্ঠীর মিশ্রন।

২) কোন একটার জাতি এককভাবে পরিশ্রমহীন, আবেগি বা দূর্বল হয় না। বাংলাদেশেই (এবং আরোকিছু থার্ড ওয়ার্ল্ডের দেশে) সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে বেশি খাটে মানুষ,গার্মেন্টস সেক্টরে; আর সবচেয়ে কম অবসর পায়। চিপ লেবারের দেশে মানুষ পরিশ্রম করে না, এটা শুনলে হাঁসি পায়।

৩) কোন রেইসের,গোষ্ঠীর বা মানুষের কোন আচরণগত বৈষিষ্ট্য শুধু তার জৈবিকতার ফলাফল না, এটার তার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক – এমন অনেকগুলো ফ্যাক্টরের কারণে গড়ে ওঠে।

তাসনিম রিফাত

তাসনিম রিফাত

জন্ম ১৯৯৮ সাল। ঢাকায় থাকেন। সাহিত্য ও নৃবিজ্ঞান নিয়া পড়াশোনা করতে পছন্দ করেন।

  • February 4, 2023